সমস্ত লেখাগুলি

মহাপ্লাবন: এক নির্মম রিসেটের গল্প -
Guitar K Kanungo
May 27, 2025 | category | views:23 | likes:1 | share: 0 | comments:0
মহাপ্লাবন এবং নোয়ার একটা জাহাজ নির্মাণ করে সমগ্র প্রাণীজগৎকে রক্ষা করার ঘটনা আমরা সবাই জানি। বাইবেলে এই ঘটনার কথা বিশদভাবে বলা আছে। সম্প্রতি জুলিয়ান বার্নসের লেখা A History of the World in 10½ Chapters পড়লাম। সেখানে “The Stowaway” নামের একটি অধ্যায় আছে। এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বেশ মজার।
একটি ঘুণপোকা—যাকে নোয়া তাঁর জাহাজে তোলার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেননি—সে নোয়ার অজান্তেই ওই জাহাজে উঠে পড়ে। জাহাজেই থেকে সেই ঘুণপোকা নোয়ার প্রাণীকূলকে বাঁচিয়ে রাখার সেই বিশাল কর্মকাণ্ডের একটি ক্রিটিকাল এনালাইসিস দেয়ার চেষ্টা করে। এনালাইসিসটি ভাবনার খোরাক জোগানোর মতো।
ঘুণপোকাটির মতে, নোয়া ও তাঁর নৌকার কাহিনি মোটেও কোনো মহৎ ঈশ্বরীয় পরিকল্পনা ছিল না। বরং এটি ছিল এক ধরনের ষড়যন্ত্র। নোয়া নিজেই ছিলেন একজন কর্তৃত্বপরায়ণ, পক্ষপাতদুষ্ট নেতা। তিনি নিজের খেয়ালমতো প্রাণীদের নির্বাচন করেছিলেন এবং যাদের ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করেছেন, তাদের জাহাজে স্থান দেননি।
নোয়া কিছু প্রাণীকে নোংরা, ক্ষতিকর বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অপবিত্র মনে করে তাদের বাদ দেন। কিন্তু ঘুণপোকা প্রশ্ন তোলে—কারা ঠিক করবে কোন প্রাণী পবিত্র আর কোনটা নয়? সে নিজেকে এক উদাহরণ হিসেবে হাজির করে—নোয়ার চোখে সে অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সহস্র বছর ধরে কাঠের গঠন, ইতিহাস এবং সভ্যতার অংশ।
বাইবেলে নোয়ার নৌকা এক শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল রক্ষা কেন্দ্রের মতো চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু ঘুণপোকার কাছে নৌকার পরিবেশ মোটেই সেরকম মনে হয়নি। গোটা পরবিশটাকে তার কাছে বিশৃঙ্খল ও স্বৈরতান্ত্রিক মনে হয়েছিল—যেখানে বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে হিংসা, খাদ্যসংকট এবং নিপীড়নের পরিবেশ বিদ্যমান ছিল।
ঘুণপোকা আমাদের জানায়, অনেক প্রাণীকে বাধ্য করা হতো নীরব থাকার জন্য, যাতে নোয়া বা তাঁর পরিবার বিরক্ত না হয়। যারা আওয়াজ করত বা “দায়িত্ব পালন করত না,” তাদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দেওয়া হতো বা ফেলে দেওয়া হতো। এটা ছিল এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত সমাজ, যেখানে নোয়া ও তাঁর পরিবারই ছিল একমাত্র কর্তৃত্ব।
ঘুণপোকা বারবার প্রশ্ন তোলে: সত্যিই কি এটি ঈশ্বরের পরিকল্পনা ছিল? নাকি নোয়ার নিজস্ব সুবিধা ও ধারণা অনুসারে এটি পরিচালিত হচ্ছিল? নোয়া যেভাবে প্রাণীদের নির্বাচন করেন, সেটিকে ঘুণপোকা এক ধরনের “নোয়া-ব্র্যান্ডেড” নৈতিকতা হিসেবেই দেখে—যেখানে একমাত্র নোয়ার মূল্যবোধই বিচার্য।
ঘুণপোকার মনে প্রশ্ন জেগেছিল—ইউনিকর্ন বাদ পড়ল কেন? নৌকায় ঠাঁই না পাওয়ার পেছনে তার অপরাধটা কী ছিল? না কি শুধুই পৌরাণিক ভেবে তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল?
ঘুণপোকা একটি গভীর দার্শনিক তর্ক সামনে তুলে আনে। সে বলে, “ওই জাহাজে আমি এবং আমার মতো আরও অনেকেই ছিলাম, কিন্তু আমাদের গল্প কেউ বলেনি।” বাইবেলে নোয়ার গল্প অমর হয়ে আছে, কিন্তু ঘুণপোকা মতো প্রাণীদের কণ্ঠ হারিয়ে গেছে ইতিহাসের গহ্বরে।
কাঠপোকা একটি চরম সত্য তুলে ধরে: তারা নৌকায় ছিল, তারা প্লাবনের মধ্য দিয়ে বেঁচে ছিল, কিন্তু কখনও কেউ তাদের কথা জিজ্ঞেস করেনি। তারাই সেই লুকিয়ে থাকা সত্য, যাদের কেউ দেখতে পায় না।
ঘুণপোকার কাছে মনে হয়েছিল, ওই মহাপ্লাবন ছিল একটি ক্রুয়েল রিসেট—এক নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ, যেখানে নিরীহ প্রাণী ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। নোয়া শুধুমাত্র মানুষ ও নির্দিষ্ট কিছু প্রাণীকে বাঁচিয়ে একটি “নতুন পৃথিবী” গঠন করেন।
কিন্তু ঘুণপোকা প্রশ্ন তোলে—ঈশ্বরের পরিকল্পনা যদি এতটাই ন্যায়সঙ্গত হতো, তবে হাজারো প্রাণী কেন মারা গেল? কেন একটি পুরো প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হলো শুধুমাত্র মানুষের জন্য?
ঘুণপোকার এই প্রশ্নটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একজন সাহিত্য সমালোচক বলছেন, “The Stowaway” অধ্যায়ে ঘুণপোকাটি শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং ইতিহাসের সেই বিস্মৃত কণ্ঠস্বর—যারা প্রশ্ন করে, স্মরণ করিয়ে দেয় এবং প্রচলিত বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
এটি লেখক বার্নসের উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিখুঁত প্রকাশ—যেখানে ‘সত্য’ আপেক্ষিক, এবং ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই একটি পক্ষপাতদুষ্ট নির্মাণ, যে ইতিহাস কেবল তারাই লেখে যারা বিজয়ী হয়।
ফিক্শন পড়ে আমি সবসময় আমি আনন্দ পাই, এমন কথা বলতে পারব না ; কিন্তু জুলিয়ান বার্নসের এই বইটি পড়ে বেশ আনন্দিত হয়েছি। মগজে নাড়া পড়েছে - মহাপ্লাবনের মত একটা ঘটনা, যেটা কেবল বাইবেলে বর্ণিত একটা কল্পকাহিনীই নয়, অনেক প্রত্নতাত্বিক বিশ্বাস করেন অতীতের কোন এক সময়ে পৃথিবী সত্যিই এক মহাপ্লাবনের মুখোমুখি হয়েছিল, সেটাকে নতুন আঙ্গিক থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
বেশ কয়েক বছর আগে জর্জ অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্ম পড়ে মগজে এরকম একটা ধাক্কা লেগেছিল।
অমৃত আসলে কী? -
Guitar K Kanungo
April 10, 2025 | category | views:42 | likes:0 | share: 0 | comments:0



পুরাণ বলছে, অমৃত এমন একটা বস্তু, যেটা পান করে দেবতারা অমর হয়ে উঠেছিলেন। একথার আরেকটা মানে হল—দেবতারা অমৃত পান করার আগে পর্যন্ত অমর ছিলেন না। পুরাণ আমাদের একথাও বলছে, একটা সময় পর্যন্ত দেব-দানবের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ হত এবং সেই যুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক দেবতাই মারা যেতেন। দেবতাদের হাতে অনেক দানব আহত, এমনকি মৃত্যুপথযাত্রী হলেও, তাদের গুরু, শুক্রাচার্য্য, মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের সাহায্যে তাদের বাঁচিয়ে তুলতেন। ফলত দেবতারা বেশ কিছুটা নিগ্রহের ভেতর দিয়েই যাচ্ছিলেন।

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে, এদিকে আবার দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের উপর নেমে এলো দুর্বাসার অভিশাপ। অহংবোধে তাড়িত হয়ে, ইন্দ্র দুর্বাসার দেয়া উপহার অবজ্ঞা করার ফলে শ্রীহীন, তথা শক্তিহীন হয়ে পড়লেন। নিরুপায়, অসহায় দেবতারা এবার ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। ভগবান বিষ্ণু সবই জানতেন। তিনি দেবতাদের সমুদ্র মন্থন করবার নির্দেশ দিলেন। বললেন—মন্থনের ফলে যে অমৃত উঠে আসবে, সে অমৃত পান করে দেবতারা অমর হয়ে উঠবেন। দানবেরা আর দেবতাদের সাথে পেরে উঠতে পারবে না।

সমুদ্র মন্থন কিভাবে হয়েছিল, সে গল্প আমরা মোটামুটি সবাই জানি, তবে মন্থনের দড়ি হিসাবে বাসুকি নাকি অনন্ত নাগ ব্যবহৃত হয়েছিল, এই নিয়ে পুরাণ সমূহে কিছুটা বিরোধ আছে। তবে মন্থনের শেষ পর্যায়ে যে অমৃত নিয়ে ধন্বন্তরি উঠে আসেন, সেটা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু নিজেও এই মন্থনকাজে অংশ নিয়েছিলেন। দেব-দানবের 'অমানুষিক' টানাটানির এক পর্যায়ে, মন্দার পর্বত ক্ষিরোদ সাগরের অভ্যন্তরে ডুবে যেতে থাকলে, ভগবান বিষ্ণু নিজে কুর্ম তথা কচ্ছপ অবতারে পর্বতের নিচে অবস্থান করে মন্দার পর্বতকে ধারণ করে থাকেন। অমৃতের পাশাপাশি, মন্থনের ফলে হলাহলও উঠে এসেছিল, যেটা পান করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেন।

এই মন্থনের ফলে দেবী লক্ষ্মী (এবং অপ্সরারা) সহ আরও বেশ কিছু সামগ্রী উঠে আসে। কামধেনু সুরভি, ইন্দ্রের ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবা, কৌস্তুভ মণি ইত্যাদি সেসব সামগ্রীর অন্যতম। কিন্তু আমাদের কেবল মনে রাখতে হবে, অমৃত হাতে যিনি উঠে আসেন, তাঁর নাম ধন্বন্তরি এবং পরবর্তীতে তিনি দেবতাদের প্রধান চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত হবেন। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, ভগবান বিষ্ণুর আদেশে মন্থন শুরু করবার আগে বিপুল পরিমাণ নানান প্রকারের লতাগুল্ম ইত্যাদি ক্ষিরোদ সাগরে ফেলা হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল মন্থন। এই লতা-গুল্ম ফেলে দেবার কথাটাও আমাদের বিশেষ করে মনে রাখতে হবে।

ঠিক এইখানে আমরা আরেকবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের আলোচনায় ফেরত যাব। শুরুতে আমরা বলেছি—দেব-দানবের যুদ্ধে নিহতদের, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের সাহায্যে বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। এই ক্ষমতাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের, তবে শুক্রাচার্য যে একজন সময়ের চাইতে এগিয়ে থাকা ভেষজ চিকিৎসক ছিলেন, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মৃতদের বাঁচাতে না পারলেও, তিনি তাঁর আবিষ্কৃত কোন এক পাঁচন তথা ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে আহত দানবদের নিশ্চয়ই বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন। রামায়ণে সুষেণ নামের এক বৈদ্যের পরামর্শে আমরা হনুমানকে গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যকরণী নামের ঔষধী গাছ আনতে ছুটতে দেখব।

যুদ্ধে আহতদের সরিয়ে তোলার জন্যে দেবতাদের এরকম একজন চিকিৎসক এবং একরকম একটা পাঁচনের প্রয়োজন ছিল। ধন্বন্তরি হলেন শুক্রাচার্যের দেবকুল সংস্করণ, আর অমৃত হল শুক্রাচার্যের আবিষ্কৃত পাঁচন। যে পদ্ধতিতে মন্থনের কথা বলা হয়েছে, যে পদ্ধতিতে অমৃত উঠে এসেছে—একটু মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ঠিক একই পদ্ধতিতে ভেষজ চিকিৎসকরা পাঁচন তৈরি করে থাকেন। তফাৎটা কেবল এই—দেবতারা যেখানে যে কাজটা ক্ষিরোদ সাগরে করে থাকেন, আজকালকার দিনের ভেষজ চিকিৎসকরা সেই কাজটা হামানদিস্তায় করে থাকেন। আনুষাঙ্গিক উপকরণ কিছুটা ভিন্ন, উপাদান এবং পদ্ধতি অনেকটাই একই রকম।

আরেকটা কথা—দেবী লক্ষ্মী, অপ্সরা এবং সুরভীর উঠে আসা—এসব পৌরাণিক বাগাড়ম্বর; এসবকে আমাদের এক পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, অমৃত নিয়ে দেবী লক্ষ্মীও উঠে আসতে পারতেন। তিনি পরবর্তীতে ভগবান বিষ্ণুর বক্ষলগ্না হবেন। অতএব, তাঁর সেই যোগ্যতা ছিল, কিন্তু ঘটনাটা ঠিক সেইভাবে ঘটেনি। যে অমৃতের জন্য এতো আয়োজন, সেই অমৃত নিয়ে যিনি উঠে এসেছেন তিনি আর স্বয়ং ধন্বন্তরি—যিনি একজন চিকিৎসক। যদি অমৃত একবার পান করলেই সবাই অমর হয়ে যেত, তাহলে ধন্বন্তরির উঠে আসবার প্রয়োজন ছিল না। আসলে, মন্থনের নানান বর্ণনার মধ্যে অমৃত আসলে কী, তার ইঙ্গিত দেয়া আছে। আমাদের সেই ইঙ্গিতগুলিকে বুঝতে হবে।

তবে সব কথা শেষ হবার পরেও একটা কথা আছে। পুরাণ বলেছে, শুক্রাচার্য মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র পেয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের কাছ থেকে। যদি এই বিদ্যাকে আমরা ভেষজ বিদ্যা বলে ধরে নিই, তাহলে অবশ্য একটা প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিত থেকেই যায়। সমুদ্র মন্থন ছিল এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেবতারা মহাদেবের কাছে গেলেন না কেন এই বিশেষ জ্ঞানের জন্য? তাহলে তো সমুদ্র মন্থনের মত এক বিশাল কর্মযজ্ঞের আয়োজন করার প্রয়োজন হতো না ! দেবতাদের রক্ষার্থে যিনি নীলকণ্ঠ হতে পারলেন, তিনি নিশ্চয়ই দেবতাদের কাউকে এই জ্ঞান খুব সহজেই শিখিয়ে দিতে পারতেন।

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন—হনুমান গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনে শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু বুদ্ধির পরিচয় দেননি। একই কাজ দেবতারাও করছেন।

চোখ ঢেকে গান্ধারী দায়িত্ব এড়িয়েছেন মাত্র। -
Guitar K Kanungo
April 2, 2025 | category | views:170 | likes:0 | share: 0 | comments:0
কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পেছনে সমস্ত দায় কৃষ্ণের— গান্ধারী এই মর্মে কৃষ্ণকে অভিশাপও দিয়েছেন, এবং কৃষ্ণ যে সেটা মাথা পেতে নিয়েছেন, সেটা কৃষ্ণের বদান্যতা। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ধ্বংসের পেছনে এককভাবে কৃষ্ণ দায়ী— এরকম করে ভাবতে পারি না। কৌরবদের পতনের পেছনে দুর্যোধনের দায় তো ছিলই, দুর্যোধনের পিতা ধৃতরাষ্ট্র নিজেও অনেকটা দায়ী ছিলেন। সিংহাসন নিয়ে এই লড়াই অব্যাহতভাবে চলতে থাকার পেছনে পিতামহ ভীষ্মের অবদানও খুব একটা কম ছিল না। তিনি নিজে কখনো বিয়ে করবেন না— এরকম একটা উদ্ভট, অরাজক প্রতিজ্ঞা করে না বসলে, উত্তরকালে হস্তিনাপুরের সিংহাসন নিয়ে এই লড়াইয়ের সূচনাই হত না। এমনকি কাশী রাজকন্যা অম্বাকে নিয়ে তিনি যখন একটা ধর্মসংকটের মতো অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন পিতা শান্তনুকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে তিনি অম্বাকে বিয়ে করলে এই সংকটের সৃষ্টি হত না। একই রকম দায় গান্ধারীরও ছিল। আজকের আলোচনা সেই বিষয়ে।
অনেকেই মাতা গান্ধারীকে একজন সাধ্বী নারী হিসেবেই বর্ণনা করে থাকেন। স্বামী অন্ধ, দৃষ্টিহীন বলে তিনি স্বেচ্ছায় অন্ধত্বকে বরণ করে নিয়েছেন— এরকম একটা ধারণা মহাভারতের অনেক পাঠকের মধ্যেই আছে। অবশ্য অন্য একটা ধারণাও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, গান্ধারী ঠিক স্বামীর অন্ধত্বের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য নয়, বরং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই সারাজীবন চোখের ওপর কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিলেন। দ্বিতীয় ধারণাটাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়, কারণ গান্ধারীকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ধৃতরাষ্ট্রকে বিয়ের পক্ষে মত দিতে হয়েছিল। গান্ধারী বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণী নন; রুক্মিণী যেমন ভালোবেসে কৃষ্ণকে বিয়ে করেছিলেন, গান্ধারী সেটা করেননি। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে আদৌ ভালোবাসতেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিশেষত হস্তিনাপুরের কারাগারে তাঁর পিতা-মাতার মৃত্যু যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
গান্ধারীর চোখে কালো পট্টি বাঁধার ব্যাপারটা যদি প্রতিবাদস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে এর আরও একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। এরকমও হতে পারে যে তিনি যেদিন হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছেছিলেন, সেদিন থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন যে এই রাজ্যের ভালো-মন্দ কিছুতেই তিনি নিজেকে কোনোদিন জড়াবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু কানে তো শুনতে পেতেন! চারিদিকে কী ঘটছে, সে খবর তাঁর কানে পৌঁছায়নি— এমন ভাবার তো কোনো কারণ নেই। যেদিন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হলো, সেদিন রাজসভায় তিনি হয়তো ছিলেন না, কিন্তু এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন তো তিনি অন্তঃপুরে ছিলেন। ঘটনার খবর নিশ্চয়ই তাঁর কানে পৌঁছেছিল! কিন্তু তাঁকে তো এই ঘটনা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা গেল না। অন্ধ হয়ে থাকলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে? না, এই ক্ষেত্রেও থাকেনি। অন্যদের মতো মাতা গান্ধারীও জানতেন— দ্রৌপদীর প্রতি দেখানো এই অসম্মান কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার অন্যতম কারণ।
হতে পারে, পাণ্ডবদের পিতৃত্ব নিয়ে দুর্যোধনের সন্দেহ ছিল। সেই জন্যেই হস্তিনাপুরের সিংহাসনের ওপর পাণ্ডবদের দাবি সে কখনোই মেনে নিতে পারেনি। মুশকিল হচ্ছে, এইভাবে দেখলে তার পিতারও হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসার অধিকার নেই, কারণ তিনি মহারাজ শান্তনুর ঔরসজাত সন্তান ভীষ্মের বংশধারায় জন্মাননি। তিনি আসলে মহর্ষি ব্যাসদেবের পুত্র— হস্তিনাপুরের সঙ্গে যার সেই অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই। তবুও দুর্যোধন পাণ্ডবদের দুচোখে দেখতে পারত না। এই নিয়ে প্রধানত দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে দুর্যোধনের একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রতিহিংসামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দুর্যোধন ছোটবেলাতেই ভীমকে একবার বিষ খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত ভীম বেঁচে যায়। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া অত্যন্ত ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা— এবং রানী গান্ধারী নিশ্চয়ই এই ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি কি কখনো পুত্র দুর্যোধনকে ভৎসনা করেছিলেন? সেরকম কোনো খবর আমাদের মহর্ষির লেখায় পাওয়া যায় না। তাঁকে হত্যার এই চেষ্টার কথা ভীম ভুলে যায়নি এবং দুর্যোধনকে হত্যা করেই সে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছিল।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, পুত্র-স্নেহেও অন্ধ ছিলেন; তাঁর মধ্যে লোভও ছিল। শারীরিক বৈকল্যের কারণে তাঁর রাজা হওয়ার কথা ছিল না। ছোটভাই পান্ডুর হয়ে রাজ্য চালাচ্ছিলেন তিনি। বিধি অনুযায়ী পান্ডুর ছেলেদের তাদের পিতার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তিনি সেটা করেননি। শুধু তাই নয়, তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে পুত্র দুর্যোধনই রাজা হোক। পান্ডুর পুত্রদের হস্তিনাপুর থেকে দূরে রাখার দুর্যোধনের সমস্ত চেষ্টাকে কখনো সরবে, কখনো নীরবে সমর্থন করেছেন। একই ছাদের নিচে থেকে তাঁর পুত্রদের সমস্ত অপকর্মের কথা ধৃতরাষ্ট্র যেমন জানতেন, তেমনি গান্ধারীও জানতেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, কিন্তু গান্ধারী অন্ধ না হয়েও অন্ধের মতোই ছিলেন। ন্যায়ত যদি ধৃতরাষ্ট্র একজন দুষ্টু লোক হন, তবে একই অভিধা গান্ধারীরও পাওয়া উচিত। কিন্তু পাঠকেরা গান্ধারীকে একজন সাধ্বী নারী হিসেবেই দেখে এসেছে। মজার ব্যাপার হলো, গান্ধারীকে পুরোপুরি সাধ্বী বলা যায় না— সেই ইঙ্গিত কিছুটা বাসুদেব কৃষ্ণ দিয়েও রেখেছেন।
কীভাবে দিয়েছেন, সেই গল্পটা এখানে প্রাসঙ্গিক। গান্ধারী জানতেন, ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিল উরু ভেঙেই দুর্যোধনকে হত্যা করবে, যেহেতু দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে উরু দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছিল। দুর্যোধন যে অনুচিত কাজ করেছিল, তা জেনেও গান্ধারী ভীম যাতে এই কাজটা করতে না পারে, সেই জন্য সচেষ্ট হন। বলা হয়ে থাকে, তিনি যেহেতু স্বামীর সঙ্গে সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে পুরো বিবাহিত জীবন চোখে কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিলেন, সেই জন্য তাঁর দৃষ্টিতে এক বিশেষ রকমের ক্ষমতা জন্মেছিল। তিনি দুর্যোধনকে সেই দৃষ্টি দিয়ে অবধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই একদিন দুর্যোধনকে পুরো নগ্ন হয়ে তাঁর কাছে আসতে বললেন। দুর্যোধন সেই মোতাবেক মায়ের সামনে হাজির হতে চলেছিলেন, কিন্তু পথে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। কৃষ্ণ বললেন, "মায়ের সামনে একেবারে দিগম্বর হয়ে যাওয়াটা কি তোমার জন্য শোভন? অন্তত শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে রাখা উচিত।" দুর্যোধন তাই করলেন। গান্ধারীর দৃষ্টি দুর্যোধনের শরীরকে অবধ্য করতে পারল না, কারণ সে দুর্যোধনের শরীর পুরোপুরি অনাবৃত ছিল না। গান্ধারীর এই ব্যর্থতা নির্দেশ করে, তাঁর এই স্বেচ্ছা-অন্ধত্বকে সব সময় গৌরবজনক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
তুমি কেমন ঈশ্বর, যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ কর! -
Guitar K Kanungo
March 30, 2025 | category | views:41 | likes:1 | share: 0 | comments:0

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শুরুতে বাসুদেব কৃষ্ণ বলেছিলেন, তিনি এই যুদ্ধে কারো পক্ষ নেবেন না। এই কথা শুনে মহামতি ভীষ্ম বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়েই ছাড়বেন। এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, ভীষ্ম ছিলেন সেই গুটিকয়েক মানুষদের একজন, যিনি জানতেন বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান কৃষ্ণের অবতার। ভীষ্ম যে এটা জানতেন, সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে প্রদান করা উচিত, এই প্রশ্ন উঠতেই ভীষ্ম দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, যদুকুলশ্রেষ্ঠ বাসুদেব কৃষ্ণই এই অর্ঘ্য গ্রহণ করার সবচাইতে যোগ্যতম ব্যক্তি। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষ্ণ কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন না। তবুও ভীষ্ম এই প্রস্তাব করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন কৃষ্ণবর্ণের ওই মানুষটি রাজাদের রাজা, ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার। ভীষ্ম ছিলেন বিষ্ণুর পরম ভক্ত।

এই যুদ্ধে পান্ডবদের ভরসা ছিল অর্জুনের ক্ষাত্রশক্তির উপর। কিন্তু সেই অর্জুন যুদ্ধ করতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। পরম আত্মীয়দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, বিশেষ করে ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণের বিরুদ্ধে তো বটেই। সেই যখন মা কুন্তীর হাত ধরে প্রথম হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, সেদিন যে মানুষটি হাত বাড়িয়ে তাদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তিনি পিতামহ ভীষ্ম। অন্যদিকে, আচার্য দ্রোণ নিজের ঔরসজাত সন্তান অশ্বত্থামার চাইতেও যাকে বেশি ভালোবাসতেন, তিনি ছিলেন অর্জুন। অর্জুন ছিলেন তাঁর প্রিয়তম শিষ্য; নিজের সমস্ত অস্ত্রজ্ঞান উজাড় করে শিখিয়েছিলেন এই প্রিয় শিষ্যকে। অর্জুনের চাইতে বড় বীর হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি নিষাদ একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে নিয়েছিলেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে। সেই আচার্য দ্রোণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে হবে! তাঁদের হত্যা করতে হবে! অর্জুন ভাবতেই পারছিলেন না!

কেশব অর্জুনকে অনেক বোঝালেন। কেন কঠিন হলেও এই কাজটা অর্জুনকে করতে হবে, সেটা বেশ ভালো করে বোঝালেন। গীতার আবির্ভাব ঘটল। তবুও অর্জুন ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। এবার কৃষ্ণ তাঁকে বিশ্বরূপ দেখালেন। অর্জুন শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে অর্জুন গীতার সমস্ত উপদেশ বেমালুম ভুলে গেলেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে পিতামহ ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণকে দেখে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে উঠল। এদের দুজনের কাউকেই তিনি বধ করতে পারছিলেন না, যদিও দ্রোণের শিখিয়ে দেওয়া সমস্ত জ্ঞান ছাড়াও তাঁর সংগ্রহে ছিল বেশ কিছু দিব্যাস্ত্রের মজুদ। এঁদেরকে ঘিরে সমস্ত স্মৃতি অর্জুনকে একেবারে আবিষ্ট করে ফেলেছিল।

এদিকে দুর্যোধনের নিদারুণ নিগ্রহে অতিষ্ঠ হয়ে ভীষ্ম যুদ্ধক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। এখানে বলে নেয়া দরকার, মহাভারতের গুটিকয়েক অতিমহারথী যোদ্ধার মধ্যে ভীষ্ম একজন। পান্ডবদের ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা না করলেও তিনি কুরুক্ষেত্রের ময়দানকে রক্তাক্ত করে তুললেন। পান্ডব শিবিরে রীতিমত হাহাকার পড়ে গেল। অর্জুন কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না ভীষ্মের সঙ্গে। সেদিন ছিল যুদ্ধের নবম দিন। কৃষ্ণ দেখলেন, এভাবে চলতে থাকলে পাণ্ডবদের পরাজয় অনিবার্য। এরকম একটা অবস্থায় কৃষ্ণ রথ থেকে নেমে এসে রথের চাকা তুলে নিয়ে ভীষ্মকে বধ করতে এগিয়ে গেলেন। কৃষ্ণ পার্থেরই সারথি ছিলেন; পার্থ দ্রুত রথ থেকে নেমে এসে কৃষ্ণের পায়ের উপর আছড়ে পড়লেন একেবারে। মিনতি করে বললেন, তিনি যেন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ভীষ্মকে বধ না করেন। এদিকে কৃষ্ণকে এগিয়ে আসতে দেখে ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে রথের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখে স্মিত হাসি। তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়ে ছাড়বেন। সেটা তিনি করতে পেরেছেন।

প্রশ্নটা এখানেই ওঠে। কেন তাহলে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে না পারেন? তিনি যদি ঈশ্বরের অবতার হয়েই থাকেন, তাহলে তাঁর আগে থেকেই জানা উচিত ছিল, গীতার বাণী ব্যর্থ হবে, অর্জুন ব্যর্থ হবেন এবং এক পর্যায়ে তাঁকে সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। যদি তিনি সেটা আগে থেকে না জেনে থাকেন, তাহলে তো তিনি ভগবানই নন।

এমন একটা প্রশ্ন বাইবেলের ঈশ্বরকেও ঘিরে উঠেছিল। তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন, তারপর সেই আদমকে ইডেন গার্ডেনে ছেড়ে দিলেন। কিছুদিন পর ঈশ্বরের মনে হল, আদম নিঃসঙ্গ বোধ করছে, অতএব তার একজন সঙ্গী দরকার। আদম যে নিঃসঙ্গ বোধ করবেন, সেটা ঈশ্বর আগে থেকেই বুঝতে পারেননি কেন? যাই হোক, তিনি এবার ইভকে বানিয়ে আদমের সঙ্গে বসবাসের জন্য ইডেন গার্ডেনে ছেড়ে দিলেন। সেই গার্ডেনে একটা বৃক্ষ ছিল, যে বৃক্ষের ফল খেতে তিনি বারণ করে দিয়েছিলেন। ইভ সে আদেশ অমান্য করলেন। এখানেও প্রশ্ন উঠতে পারে, ঈশ্বর কি তাহলে আগে থেকে জানতেন না ইভ প্ররোচিত হবেন?

প্রতিজ্ঞা ভীষ্মও করেছিলেন, কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছেন। এমনকি এই কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটাই শেষ পর্যন্ত হতো না, যদি তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পিতা শান্তনুর রেখে যাওয়া সিংহাসনটা নিজের দখলে নিতেন। যাই হোক, এইরকম একটা বিপ্রতীপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল বলেই কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হওয়ার কারণটা জানা জরুরি। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, কৃষ্ণ আগে থেকেই জানতেন গীতার উপদেশ শোনার পরেও অর্জুন সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারবেন না এবং তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সেটা নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। অর্জুনকে আরেকবার উজ্জীবিত করার প্রয়োজন ছিল। রথের চাকা নিয়ে কৃষ্ণ ভীষ্মের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন যতটা না ভীষ্মকে বধ করার উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে বেশি অর্জুনকে উজ্জীবিত করার জন্য। অর্জুন উজ্জীবিত হলেন। তিনি কৃষ্ণকে প্রতিজ্ঞা করলেন, এরপর থেকে তিনি ক্ষত্রিয়ের মতোই লড়াই করবেন।

কিন্তু এই উত্তর কি যথাযথ? গ্রহণ করার মতো? নিশ্চয়ই নয়। এই উত্তর গ্রহণযোগ্য, যদি কৃষ্ণকে অর্জুনের একজন মেন্টর হিসেবে দেখি কিংবা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে যদি একজন কোচ হিসেবে দেখি। কিন্তু কৃষ্ণকে যদি একজন অবতার হিসেবে দেখি, তাহলে এই উত্তর গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। তিনি যখন অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন, তখনই তো অর্জুনের মনোভাব বদলে দিতে পারতেন। তাঁর মনকে সমস্ত মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিতে পারতেন। তিনি সেটা করেননি। এদিকে ভীষ্মকে হত্যা করতে ছুটে যাওয়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা এবং ঘটনাটি আকস্মিক বলেই এটা অর্জুনকে উজ্জীবিত করার জন্য করেছেন, এমন ভাবার সুযোগ খুবই কম। তাহলে?

ঠিক এই জায়গায় এসে আরেকটি ঘটনার কথা বলতে হয়, যে ঘটনার কিছুটা আগেই বলা হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে কৃষ্ণ যখন বলেছিলেন, তিনি কোনো পক্ষেই যোগ দেবেন না, তখন ভীষ্ম বলেছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে অস্ত্র ধরিয়েই ছাড়বেন। ভীষ্ম সেটা করতে পেরেছিলেন। আবারও প্রশ্ন উঠবে, কৃষ্ণ সেটা হতে দিলেন কেন? কেউ কেউ বলেন, কৃষ্ণ সেটা হতে দিলেন, কারণ তিনি যে ভক্তের ভগবান। ভীষ্ম ছিলেন তাঁর পরম ভক্ত। ভক্তের ইচ্ছাকে মূল্য দিতে গিয়েই তিনি অস্ত্র ধারণ করেছিলেন, নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও আরেকটি প্রশ্ন ওঠে। যুদ্ধের শুরুতে ভীষ্মকে যে মাপের যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই বর্ণনা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন তো বটেই, ভীষ্মের চাইতেও বড় মাপের যোদ্ধা ছিলেন। তারপরও কৃষ্ণ কি ভীষ্মকে বধ করতে পারতেন? পারতেন না - ভীষ্ম মৃত্যুকে জয় করছিলেন। তাঁর হাতে যতক্ষণ অস্ত্র আছে ততক্ষন তাঁকে কেউ বধ করতে পারত না, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও নন। তাহলে কৃষ্ণ তাঁকে মারতে ছুটে গিয়েছিলেন কেন ?

রামায়ণ ও মহাভারতে নৈতিকতা : একটি খন্ডচিত্র -
Guitar K Kanungo
March 26, 2025 | পুরাণ | views:61 | likes:0 | share: 1 | comments:0

রামায়ণে ঘটে যাওয়া দুটি হত্যাকাণ্ডকে আমি নীতিবিরুদ্ধ এবং গর্হিত অপরাধ বলে মনে করি। এই দুটি হত্যাকাণ্ড স্বয়ং রামচন্দ্রই ঘটিয়েছেন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের অজুহাতে দ্বাপর যুগে বাসুদেব কৃষ্ণ অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, কিন্তু খুব সীমিত ক্ষেত্রেই তিনি নিজ হাতে কাউকে হত্যা করেছেন।

কংস দুরাচারী ছিলেন; তাঁকে উৎখাত করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। মগধরাজ জরাসন্ধের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন। নিজের পিতা উগ্রসেনকে হটিয়ে মথুরার রাজা হয়ে বসেছিলেন। অন্যদিকে, কৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেছেন তাঁর একশটি অপরাধ ক্ষমা করার পর। এই দুটো হত্যাকাণ্ডের কোনোটাই কোনো প্রকার ছলনার আশ্রয় নিয়ে করা হয়নি।

রামচন্দ্রের হাত দিয়ে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। শূদ্র বংশোদ্ভূত শম্বুক ঈশ্বরের তপস্যা করছিলেন। "শূদ্রের ঈশ্বরের তপস্যা করার অধিকার নেই"—এই অজুহাতে শম্বুককে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার তীব্র বর্ণবৈষম্যের একটি প্রতীকী উদাহরণ এবং উদাহরণটা সৃষ্টি করছেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলে কথিত রামচন্দ্র।

কিস্কিন্ধ্যার রাজা বালীর সঙ্গে রামচন্দ্রের কোনো শত্রুতা ছিল না। যিনি মহাপরাক্রমশালী রাবণকে বগলের নিচে চেপে ধরে অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়াতেন, সেই রাজা বালীর মৃত্যুটা এতটা অসম্মানজনক না হলেও পারত। কিন্তু রামচন্দ্র পিছন দিক থেকে অতর্কিতে তীর ছুঁড়ে বালীকে হত্যা করেন।

জরা নামের যে ব্যাধের হাতে বাসুদেব কৃষ্ণ নিহত হয়েছিলেন, তিনি ত্রেতা যুগে রামের হাতে নিহত হওয়া কিস্কিন্ধ্যার রাজা বালী। রামচন্দ্র বালীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন; সেই কারণে দ্বাপর যুগে এসে বালীকে সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। মহাভারত আমাদের সেই খবর দিচ্ছে।

এই ঘটনা থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—বাল্মীকি বালী হত্যার পেছনে যত যুক্তিই দাঁড় করানোর চেষ্টা করুন না কেন, মহাভারত রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস সেইসব যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। অবশ্য এটাও ঠিক, মহাভারতেও আমরা এমন অনেক দ্বৈরথ দেখতে পাব, যেখানে বেশ অন্যায়ভাবেই প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়েছিল। মগধরাজ জরাসন্ধ এবং কৌরবজ্যেষ্ঠ দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধের নিয়ম ভেঙেই হত্যা করা হয়েছিল।

অনেকটা একই অবস্থা ছিল লঙ্কেশ রাবণেরও। শিবের বরপ্রীতি লাভ করে রাবণ অনেকটা অমর হয়ে উঠেছিলেন। রামায়ণ যে জায়গাটাকে কিস্কিন্ধ্যা নামে চিহ্নিত করেছে, সেটা বর্তমান সময়ের রামেশ্বরমের অদূরে। রামায়ণ এটাও বলেছে, কিস্কিন্ধ্যা থেকে সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কার দূরত্ব ১০০ যোজন, অর্থাৎ সর্বোচ্চ প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, যে জায়গাটাতে বানরসেনারা রামসেতু নির্মাণ করেছিল, সেটার এপারে কিস্কিন্ধ্যা, ওপারে লঙ্কা।

বালীর বিক্রমের কথা রাবণ জানতেন। একদিন কিস্কিন্ধ্যায় এসে রাবণ বালীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। কাজটা বোকামি হয়েছিল, কারণ রাবণের জানা ছিল না—বালীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে না হতেই তাঁর শক্তি অর্ধেকে নেমে আসবে। ফলত যা হওয়ার, তাই হলো; রাবণ বালীর কাছে পরাজিত হলেন।

একটা প্রশ্ন তাই যৌক্তিকভাবেই ওঠে—রাম বালীকে বাদ দিয়ে সুগ্রীবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে গেলেন কেন? মৃত্যুপথযাত্রী বালী স্বয়ং এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। রামের সঙ্গে যখন সুগ্রীবের সাক্ষাৎ ঘটে, তখন সুগ্রীব রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি অনেকটাই সহায়-সম্বলহীন; বালীর মতো বিশেষ কোনো শক্তিও তাঁর নেই। অবশ্য কিছু অনুগত বানরসেনা এবং পবনপুত্র হনুমান রয়েছেন তাঁর সঙ্গে।

রাম চাইলেই সরাসরি বালীর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সাহায্য চাইতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করলেন, যিনি কিনা নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার সামর্থ্যও রাখেন না—পবনপুত্র হনুমান তাঁর সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও!

হনুমানের কথা আলাদা করে বলতে হচ্ছে। এই হনুমানের সঙ্গেও বালীর একবার একটা যুদ্ধ হয়েছিল। ব্রহ্মার বর পেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর, প্রত্যাশিতভাবেই বালী একটা সময় ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন। এদিকে হনুমান বেশিরভাগ সময় তাঁর আরাধ্য দেবতা রামচন্দ্রের উপাসনায় মগ্ন থাকতেন।

এখানে অবশ্য একটা প্রশ্ন ওঠে—সীতাহরণের ঘটনা ঘটেছিল বলেই রামচন্দ্র সীতার ফেলে যাওয়া আভরণ খুঁজতে খুঁজতে কিস্কিন্ধ্যায় এসে পড়েছিলেন। এখানে আসার পরেই হনুমানের সঙ্গে রামচন্দ্রের দেখা হয়েছিল। তাহলে রামচন্দ্র হনুমানের আরাধ্য দেবতা হয়ে উঠলেন কীভাবে?

এই প্রশ্নের যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া না গেলেও আমরা জানি—রাবণকে হারাতে পারলেও বালী হনুমানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। হনুমান এতটাই শক্তিমান ছিলেন যে তাঁর অর্ধেক শক্তি আত্মীভূত করার ব্যাপারটা বালীর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল; বালী সেটা ধারণ করতে পারছিলেন না।

এবার আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হয়—যদি সেটাই হবে এবং হনুমান যেহেতু সুগ্রীবের অনুগামী, তাহলে রামচন্দ্র কিস্কিন্ধ্যায় এসে পৌঁছানোর আগে হনুমানের সাহায্য নিয়ে সুগ্রীব বালীকে অপসারণের চেষ্টা করেননি কেন? সুগ্রীব কি তাহলে রামচন্দ্রের অপেক্ষায় বসে ছিলেন?

অভিশাপ ও যৌনতা: রামায়ণ-মহাভারতের বয়ান। -
Guitar K Kanungo
March 24, 2025 | category | views:45 | likes:11 | share: 0 | comments:0

রামায়ণ বলি আর মহাভারত, এই দুই মহাকাব্যে অভিশাপ একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। কারণে অকারণে অভিশাপ নেমে এসেছে, এবং কিছু ঋষির ভাবখানা এমন যে তারা যেন কেবল অভিশাপ দেওয়ার জন্যই উন্মুখ হয়ে আছেন। দুর্বাসা এঁদেরই একজন। কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে অভিশাপ দেয়ার ক্ষেত্রে একে রামে রক্ষা নেই সুগ্ৰীৱ দোসর অবস্থা। ব্যাস এই কাজের জন্যে কেবল দুর্বাসাকেই নয় , বিশ্বামিত্র, দধিচী এবং নারদের মত ঋষিকে একজায়গায় জড়ো করে ফেলেছেন। কখনো কখনো সেইসব অভিশাপ একেবারেই অযৌক্তিক। কিন্তু অযৌক্তিক হলেও সে অভিশাপগুলো ফলে যাচ্ছে, এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অবধারিতভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেই অভিশাপের ফল হিসেবে।

কুরু-পাণ্ডবদের আদি পুরুষ যযাতির কথাই ধরা যাক। স্ত্রী দেবযানীর দাসী হয়ে আসা রাজকন্যা শর্মিষ্ঠার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে যযাতি শ্বশুর শুক্রাচার্যের কাছ থেকে অভিশাপ কুড়োলেন। সেই অভিশাপ যে অসামানুপাতিক, সেকথা বলার সুযোগ খুব একটা নেই। অভিশপ্ত হয়ে যযাতি জরাগ্রস্ত হয়ে পড়লেনঅর্থাৎ, যে রিপুর তাড়নায় তিনি পরকীয়া প্রেমের মতো দুষ্কর্মে নিয়োজিত হয়েছিলেন, সেই রিপুকে অবদমন করার একটি সুযোগ পেলেন। কিন্তু যযাতি কামুক পুরুষ; তিনি শুক্রাচার্যের হাতে পায়ে ধরে সেই অভিশাপ এড়িয়ে যাবার উপায় বার করলেন। তারপর শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত সন্তান পুরুর সঙ্গে তিনি জরা বদল করে সকাম প্রেমের নৈমিত্তিক আয়োজনে মত্ত রইলেন। যেহেতু তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে কেবল পুরুই তাঁর জরা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিলেন, সেহেতু যযাতি এই পুরুকেই সমস্ত রাজ্য দিয়ে গেলেন। এই পুরুই ছিলেন কুরু-পাণ্ডবদের আদি পুরুষ।

এই অভিশাপ দিয়ে শুক্রাচার্য কার্যত তাঁর আত্মজা দেবযানীর গর্ভজাত সন্তানদের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়া থেকে বঞ্চিত করলেন। অবশ্য দেবযানীর জন্যে একটি সান্তনা পুরস্কার ছিল। উত্তরকালে তাঁর পুত্র যদুর বংশে ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণ অবতার বাসুদেব কৃষ্ণ জন্ম নেবেন। কথা হচ্ছে, এই ব্যাপারগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই ঘটতে পারত। পুরুর জায়গায় যদু রাজা হলেই যে কুরুবংশের স্থাপনা হত না, এমন ভাবার সঙ্গত কোনো কারণ নেই। পুরুর মাতুল বৃষপর্ব ছিলেন অসুরদের রাজা। বেশ ক্ষমতাবান নৃপতিএতটাই ক্ষমতাবান যে স্বয়ং শুক্রাচার্য তাঁর সভায় প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করতেন। সেই মাতুলের সহায়তায় পুরু আরেকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতেই পারতেন। কিন্তু সেটা হলো না; গোটা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্যে সেখানে একটি পরকীয়া প্রেম এবং একটি অভিশাপের অনুপ্রবেশ ঘটানো হলো।

লঙ্কেশ রাবণও এরকম একটি অভিশাপের শিকার হয়েছিলেন। সেই অভিশাপও যৌনতা সংক্রান্তই। মহর্ষি বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, লঙ্কেশ রাবণ ধর্ষকামী ছিলেন। সুন্দরী নারী দেখলেই তিনি কামাতুর হয়ে পড়তেন এবং সেই নারীদের ধর্ষণ করতে উদ্যত হতেন। ধর্ষকামিতা এক ধরনের সেক্সুয়াল ডেভিয়েশন তথা যৌন বিচ্যুতি; এটি সহজাত নয়। কেন তিনি এমন ছিলেন, এই নিয়ে বাল্মীকি আমাদের কোনো ব্যাখ্যা দেননি। মায়ের কারণে তাঁর মধ্যে রাক্ষস প্রবৃত্তি ছিল বলেই কি? কিন্তু মহর্ষি বাল্মীকি বৈদেহী সীতাকে অলঙ্ঘনীয় করে তোলার জন্যে আমাদের একটি গল্প শুনিয়েছেন। যদিও সেই গল্পের মধ্যে বিস্তর ফাঁকফোকর আছে, তবুও সেই গল্পটা বলা যাক।

একদিন বেদবতী নামের এক অসামান্য সুন্দরী নারীর সঙ্গে রাবণের দেখা হয়ে যায়। স্বভাবগত কারণেই রাবণ তার উপর জোরপূর্বক উপগত হতে চাইলেন। এদিকে কুশধ্বজ ঋষির কন্যা বেদবতী ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। বেদবতী তাঁকে পাবার জন্যেই তপস্যা করছিলেন। তিনি রাবণকে প্রতিরোধ করতে চাইলেন, কিন্তু রাবণ কিছু শুনতে নারাজ। বেদবতী বাধ্য হয়ে নিজেকে আগুনে বিলীন করে দিলেন, কিন্তু বিলীন হয়ে যাবার আগে তিনি রাবণকে এই বলে অভিশাপ দিলেনরাবণ যদি কোনো নারীর সঙ্গে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন তবে তার মৃত্যু হবে। শুধু তাই নয়, বেদবতী আরও বললেন, তিনি আবার জন্মাবেন এবং রাবণের মৃত্যুর কারণ হয়েই জন্মাবেন। এই বেদবতীই পরবর্তীতে সীতা হয়ে জন্মেছিলেন।

বেদবতীতে উপগত হওয়ার আগ্রহ রাবণ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সীতাকে অপহরণের কারণ যৌনতা নয়। প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই এই অপহরণ। অপহরণ করতে গিয়েই রাবণ বুঝতে পারলেন, সীতাও অসামান্য সুন্দরী বটে। বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, লংকায় নিয়ে আসার পর সীতাকে পাবার জন্যে রাবণ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আগের জন্মের বেদবতিই যে সীতা, সেটা হয়তো রাবণের জানা ছিল না, কিন্তু রাবণ বেদবতীর অভিশাপের কথা ভুলে যাননি। তিনি চাইছিলেন, সীতা নিজে থেকেই তাঁর সঙ্গে রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করুক। বাল্মীকি আমাদের জানাচ্ছেন, সেই ইচ্ছা সীতার কখনোই হয়নি। কেন হয়নি, সেটাও ভেবে দেখার মতো। কেন ভেবে দেখার মতো, সেটা বোঝার জন্যে আমাদের দ্রৌপদী এবং কীচককে নিয়ে ভারতবর্ষের এক প্রখ্যাত নাট্যকারের নাটকটি দেখে আসতে হবে। নাটকটির নাম আমার এই মুহূর্তে মনে নেই; বিষয়বস্তুটা তুলে ধরছি।

মহাভারতে দ্রৌপদী বিরাট রাজার আশ্রয়ে থাকার সময়ে এরকম একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। বিরাটরাজের শ্যালক কীচক দ্রৌপদীকে কামনা করছিলেন। ব্যাস আমাদেরকে বলেছেন, এইরকম অশ্লীল প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে দ্রৌপদী ভীমকে দিয়ে কীচককে বধ করিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ কারনাড (খুব সম্ভবত) তাঁর একটি নাটকে দেখিয়েছেন, দ্রৌপদী কীচকের এই প্রস্তাবে সানন্দে সাড়া দিয়েছিলেন। দ্রৌপদী সারা জীবন নিজেকে বঞ্চিতই ভেবে এসেছিলেন। যে অর্জুনকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, সেই অর্জুন যখন বিভিন্ন নারীর সঙ্গে একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়েছেন, সেখানে তিনি পুরোটা সময় অর্জুনের অন্য ভাইদের যৌন লালসা মেটানোর অনুষঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে গেছেন। শারীরিক চাহিদা দ্রৌপদীরও ছিল; কীচক দ্রৌপদীকে সে চাহিদা মেটানোর সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

আসল কথা হচ্ছে, যৌনতাকে এভাবেও দেখা যায়। কিন্তু সীতাকে নিয়ে সেই ঝুঁকি বাল্মীকি নিতে পারেননি। শুধু বাল্মীকি কেন, কোনো কোনো লেখক দ্রৌপদীকে কীচকের সঙ্গে মিলনের জন্যে অভিসারে পাঠাতে উৎসাহ দেখালেও, সীতাকে নিয়ে রামায়ণের মূল কাহিনীর বাইরে গিয়ে কিছু ভাববার সাহস দেখাতে পারেননি। ব্যাস কর্ণকে দিয়ে দ্রৌপদীকে বেশ্যা পর্যন্ত বলিয়েছেন। দ্রৌপদী মহাভারতের প্রধানতম নায়িকা হলেও দ্রৌপদীকে অন্যপূর্বা করে তোলার কোনো ইচ্ছে তাঁর ছিল না, যেটা সীতাকে নিয়ে বাল্মীকির ছিল। রাবণের সঙ্গে মিলিত হলে সীতা অসতী হয়ে উঠবেন এবং সীতাকে অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ ঘোষণা করা যাবে না। যদিও বাল্মীকির সেই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল করতে পারেননি। অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও সীতার সতীত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই গিয়েছিল। রাম নিজ মুখে সে কথা স্বীকার না করলেও রামের হৃদয়ে প্রবেশ করলে আমরা সেখানে এই সন্দেহের বীজটিকে উপ্ত অবস্থায় দেখতে পেতাম।

একথা ঠিক যে, সময় বাল্মীকি এবং ব্যাস মহাকাব্য লিখছেন, তখন সিগমুন্ড ফ্রয়েড জন্মাননি। যৌনতা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি, অস্পষ্টতা ছিল। আবার সেই সঙ্গে একথাও ঠিক, বিশেষ কোনো উপায়ে যৌনতাকে একটি নির্দিষ্ট ছকে বেঁধে রাখা যায়নি। যৌনতা জনিত ঈর্ষা, যৌনমিলনের অপূর্ণ ইচ্ছা জনিত হতাশা, শারীরিক মিলনের অপরাগত ইত্যাদি নানান জটিল মনস্তত্বকে তাঁদের মহাকাব্যে তুলে ধরতে হয়েছে কিন্তু একাজটা করতে গিয়ে তারা অনেকক্ষেত্রেই নানান প্রকার অভিশাপের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন। পরশুরাম জননী রেণুকার মধ্যে হয়ত যৌন অতৃপ্তি ছিল; তিনি গান্ধর্বদের জলকেলী দেখে তাঁর মধ্যে সেই ইচ্ছা জেগেছিল কিন্তু সেই ইচ্ছে জাগার ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হয়েছিল আমরা সেটা জানি। ঋষি জমদগ্নি তাঁর পুত্রদের আদেশ করেছিলেন মায়ের মাথাটা কেটে নিতে। অন্য পুত্ররা জমদগ্নির এরকম একটা অন্যায় আদেশ মেনে নিতে রাজি না হলেও পরশুরাম পিতার আদেশ মেনে নিয়ে ধড় থেকে মায়ের মস্তক আলাদা করে ফেলেছিলেন। এই গোটা কাজটাই অনুচিত এবং অযৌক্তিক ছিল।

অভিশাপের আলোচনায় ফিরে আসি। যৌনতা নিয়ে হস্তিনাপুরের রাজা পান্ডুর এক রকমের সমস্যা ছিল। এই সমস্যা এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানী ছেড়ে বনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন। সেখানে গিয়েও তিনি বিপদ এড়াতে পারলেন না। এক মতিভ্রম ঋষি একেবারে খোলা আকাশের নিচে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হচ্ছিলেন। পান্ডু বুঝতে না পেরে মিলনরত ঋষি দম্পতিকে হরিণ ভেবে নিয়ে তীর নিক্ষেপ করে বসলেন। সেই তীরের আঘাতে মৃত্যুবরণ করার আগে পান্ডুকে একটা অভিশাপ দিয়ে বসলেন। ঋষি নিজে যেরকম রমনরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে চলছেন পাণ্ডুও একদিন সেই অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হবে। খুব সম্ভবত পান্ডুর হৃদযন্ত্রে কোন একটা সমস্যা ছিল, রমণেক্লান্তির ধকল নেয়ার মত শক্তি পান্ডুর হৃদযন্ত্রের ছিল না। এই ব্যাপারটাকে কোনভাবে ব্যাখ্যা করতে না পেরে কিন্দমমুনির অভিশাপের গল্পটার অনুপ্রেবশ ঘটানো হয়েছে।

কৃষ্ণকে দেওয়া গান্ধারীর অভিশাপটি যুক্তিসঙ্গত ছিল না। -
Guitar K Kanungo
March 21, 2025 | category | views:32 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মহাভারত বলেছে কুরুবংশের মতো বাসুদেব কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই গান্ধারীর অভিশাপকে দায়ী করে থাকেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে পুত্রশোকে কাতর মাতা গান্ধারী বাসুদেব কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দিয়েছিলেন, যেভাবে তাঁর কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, সেভাবে একদিন কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংস হয়ে যাবে।

গান্ধারীর এই অভিশাপ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার—তিনি তাঁর পুত্রদের মৃত্যুর জন্য প্রধানত কৃষ্ণকেই দায়ী করেছেন। এই অভিযোগের সঙ্গে ঘটোৎকচ পুত্র বরবরিকের একটা মন্তব্যের মিল পাওয়া যায়। বরবরিক আঠারো দিনব্যাপী চলা কুরুক্ষেত্রের ওই যুদ্ধটা প্রত্যক্ষ করছিলেন। যুদ্ধের শেষে যখন তাঁকে এই যুদ্ধ সম্পর্কিত মন্তব্য করতে বলা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কেবল শ্রীকৃষ্ণকেই দেখতে পেয়েছেন। কথাটা রূপক অর্থে বলা। সহজ করে বললে, এই গোটা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। নিজে সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিয়েই তিনি এই কাজটি করেছিলেন।

মহাভারত একটি মহাকাব্য। মহাকাব্যকে মহাকাব্য করে তোলার জন্য এক বা একাধিক ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ চরিত্রের প্রয়োজন হয়। বাসুদেব কৃষ্ণ সেরকমই একটা চরিত্র। ব্যাসদেবের কাছে বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণতম অবতার। কৃষ্ণকে অবতার প্রমাণ করার একটা দায় ব্যাসদেবের ছিল। সেইজন্যে কেউ যদি মনে করেন অর্জুন এই মহাকাব্যের নায়ক, তাহলে ভুল করবেন। ইলিয়াডে আমরা হেক্টর এবং একিলিসের মধ্যে একটা জবরদস্ত লড়াই অন্তত দেখতে পেয়েছিলাম। এরকম একটা লড়াই দেখার সম্ভাবনা মহাভারতেও তৈরি হয়েছিল। কর্ণ এবং অর্জুনের মধ্যে সেরকম একটা লড়াই হতে পারত। কিন্তু কৃষ্ণ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে—এটা দেখানোর জন্য ব্যাসদেব সেই লড়াই উপভোগ করার আনন্দ থেকে পাঠকদের কার্যত বঞ্চিত করেছেন।

অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বাসুদেব কৃষ্ণই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, কিন্তু কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনের সমস্ত দায় তাঁর—গান্ধারীর এই অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন। কুরুবংশ ধ্বংসের অন্তত সত্তর শতাংশ দায় এককভাবে দুর্যোধনের। বাকি ত্রিশ শতাংশ দায় রাজা ধৃতরাষ্ট্রের এবং দুর্যোধনের মাতুল শকুনির। ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্রয় দিয়েছেন, শকুনি প্ররোচনা দিয়েছেন। কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে বাসুদেব কৃষ্ণ লাভবান হননি। মগধ রাজ জরাসন্ধকে বধ করা কৃষ্ণের নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল, এবং জরাসন্ধকে বধ করার কাজটা তিনি দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমকে দিয়েই সেরে ফেলেছিলেন, এবং সেটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই।

‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী’—এ কথাটা দুর্যোধনই বলেছিলেন। অতএব যুদ্ধটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। মহারাণী কুন্তী চাইছিলেন তাঁর পুত্ররা তাঁদের পিতার জবরদখল হয়ে যাওয়া সিংহাসন ফিরে পাক—অতএব যুদ্ধটা হোক। দ্রৌপদী চেয়েছিলেন যুদ্ধটা হোক—বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে তাঁর প্রতি যে অন্যায় এবং অসভ্য আচরণ দুর্যোধন এবং তাঁর ভাইয়েরা করেছিল, সেই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এত কিছুর পরেও একটা সময় পর্যন্ত পাণ্ডবরা যুদ্ধটা এড়াতেই চেয়েছিলেন। এমনকি যে ভীমকে আমরা ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক বলে জানি, সেই ভীমও দ্রৌপদীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে যুদ্ধটা যাতে না হয়, সে চেষ্টাই করেছিলেন। এই চেষ্টার অংশ হিসেবে পাণ্ডবদের দূত হয়ে স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ গিয়েছিলেন হস্তিনাপুরের রাজসভায় সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু সেই প্রস্তাব দুর্যোধন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, দূত অবধ্য জেনেও বাসুদেব কৃষ্ণকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেছিলেন।

দুর্যোধনের আরেকটা প্রকাণ্ড ব্যর্থতা আছে। তিনি আগাগোড়াই বাসুদেব কৃষ্ণকে ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। যদি আমরা ধরেও নিই কৃষ্ণ কোনো অবতার নন, কিন্তু তিনি যে কত বড় স্ট্র্যাটেজিস্ট, বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায় তিনি যে তাঁর সময়ের চাইতে হাজার বছর এগিয়ে, এই ব্যাপারটা দুর্যোধন বুঝতে পারেননি। পাণ্ডবেরা সেটা বুঝতে পেরেছিল এবং পেরেছিল বলেই তারা কৃষ্ণের কয়েক অক্ষৌহিনী নারায়ণী সৈন্য নয়, বরং কৃষ্ণকেই তাঁদের পক্ষে টানতে চেয়েছিল। মহাভারতের যুদ্ধটা সেদিন অর্ধেকটাই জিতে নিয়েছিল যেদিন বাসুদেব কৃষ্ণ তাঁর রথের সারথি হতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। চৈনিক সমরবিদ সান জু যেকোনো যুদ্ধকে যুদ্ধক্ষেত্রে গড়ানোর আগেই জিতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অর্জুন সেটাই করেছিলেন; দুর্যোধন সেটা করতে পারেননি, যদিও সেই সুযোগটা উন্মুক্তই ছিল।

এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে কিছুটা দায় তাঁর নিজেরও ছিল। অথবা এমনও হতে পারে তিনি মনে মনে চেয়েছিলেন এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাক। শুরু থেকেই গান্ধারীর হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজকুমারের সঙ্গে বিয়েতে মত ছিল না। তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল এই বিয়েতে সম্মত হতে। সম্মত হয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। ভীষ্মের আদেশে তাঁর পিতাসহ গান্ধার রাজ্যের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাইকে কারারুদ্ধ করে খুন করা হয়েছিল। যে হত্যার প্রতিশোধ নিতে শকুনি হস্তিনাপুরে থেকে গিয়েছিলেন। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, শকুনির এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে গান্ধারী জড়িত থাকতে পারেন। সেই সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় যখন বলা হয় দুর্যোধন এবং তাঁর অন্য ভাইয়েরা কেউ আসলে গান্ধারীর গর্ভজাত নয়। তিনি আসলে একটা মাংসপিণ্ডই প্রসব করেছিলেন। দুর্যোধন এবং তাঁর অন্য ভাইয়েরা আসলে ধৃতরাষ্ট্রের ওরসে দাসীদের গর্ভজাত সন্তান।

নিজের দোষ দেখতে না পাওয়া মানুষের সহজাত স্বভাব। গান্ধারী তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস আমাদের জানিয়েছেন, গান্ধারী বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। এদিকে বাসুদেব কৃষ্ণ বিষ্ণুরই অবতার। যদিও ধরেও নিই তিনিও চেয়েছিলেন কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাক, কিন্তু সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা যে কী ভয়াবহ হতে পারে, সেটা চাক্ষুষ করার পর গান্ধারীর মধ্যে তীব্র অনুশোচনার জন্ম হয়েছিল। তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণকে সামনে দেখে তাঁর ওপরেই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করতে চেয়েছেন। গান্ধারী হয়ত দেবতার গ্রাস কবিতার বিধবা মোক্ষদার মতো বলতে চেয়েছিলেন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি কুরুবংশের ধ্বংস চাইলেও ঈশ্বর কেন সেটা হতে দিলেন? ঈশ্বর চাইলেই সবকিছু অন্যরকম করে দিতে পারতেন!

বিদুর কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধে অংশ নেননি; চাইলে ভীষ্মও সেটা করতে পারতেন। -
Guitar K Kanungo
March 16, 2025 | পুরাণ | views:49 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মহাভারতের যুদ্ধটা ধর্ম এবং অধর্মের মধ্যকার যুদ্ধ। এই রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধটাকে মোটা দাগে এইভাবেই দেখানোর চেষ্ঠা করা হয়। পান্ডবরা ধর্মের পক্ষে, অন্যদিকে কৌরবরা অধর্মের পক্ষে। আর এই যুদ্ধটা রক্তাক্ষয়ী হয়ে উঠেছিল এমন ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্যের মত অতিমহারথী যোদ্ধাদের অংশগ্রহণের কারণে। যেহেতু যুদ্ধটা ধর্ম-অধর্মের মধ্যে সেইজন্যে প্রধানত এই দুজন যোদ্ধা এক রকমের ধর্মসঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছিলেন মহাভারতে যুদ্ধের ঠিক আগ মুহূর্তে।

কোন পক্ষে যুদ্ধ করবেন তারা? ধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করতে হলে, যেটা সবার করা উচিত, পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করা উচিত। কিন্তু ভীষ্ম এবং দ্রোণ, দুজনই অধর্ম তথা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করার সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল তারা যেহেতই কৌরবদের অন্নদাস, অর্থাৎ কৌরবদের অন্নে প্রতিপালিত সেহেতু অধর্ম হচ্ছে জেনেও কৌরবদের বিপক্ষে তাদের যুদ্ধ করার সুযোগ নেই।

এটা এক্য কুযুক্তি এবং এই কুযুক্তিটাকে আমাদের ছোটকাল থাকে শেখানো হয়েছে। অবশ্য এটাকে কুযুক্তি বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হয় না, এই ধরনের যুক্তিগুলো গ্রাহ্য করার মত কিনা সেই ব্যাপারটা আমরা অনেক সময় ঠিকঠাক পরখ করে দেখি না। কেউ একজন কিছু একটা বলেছেন, আর সেটাকেই আমার কোন প্রকার প্রশ্ন না করেই নির্ধিধায় মেনে নিই। বিশেষ করে সেই নিদান যদি জোব্বা আর টুপি পরিহিত কারো কাছ থেকে এসে থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

দ্রোণের একটা গ্রহণযোগ্য কারণ থাকলেও, ভীষ্মের কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করার কোন কারন ছিল না। দ্রোণ হস্তিনাপুর রাজ্যের বেতনভুক কর্মচারী ছিলেন - সেই অর্থে তিনি কৌরবদের অন্নদাস; ওই কারণে অধর্ম হচ্ছে জেনেও আচার্য দ্রোণের কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ না করে উপায় ছিল না কিন্তু পিতামহ ভীষ্মের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক এরকম ছিল না। কুরু রাজবংশে ভীষ্ম কখনোই একজন আউটসাইডার ছিলেন না। তিনিই ছিলেন হস্তিনাপুরের সিংহাসনের বৈধ দাবীদার। তিনি দয়া করে (প্রতিজ্ঞার খাতিরে) হস্তিনাপুরের সিংহসনটা দখলে নেননি বলেই ধৃতরাষ্ট্র, চিত্রাঙ্গদ, বিচিত্রবীর্য, পান্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরের রাজা হতে পেরেছিলেন, দুর্যোধন হতে পেরেছিলেন যুবরাজ।

একথা ঠিক দুর্যোধন কখনো কখনো ভীষ্মকে কটু কথা বলেছেন। সেটা তার স্বভাবগত কারণেই - ছোটবেলা থেকে উচ্ছন্নে গেছেন বলেই কিন্তু এহেন দুর্যোধনও পিতামহ ভীষ্মকে অতিক্রম করার চেষ্ঠা করেননি। সযত্নে তিনি এই দুস্কর্ম করা থেকে বিরত থেকেছেন কারণ পিতামহ ভীষ্ম কে, এই বংশের সুরক্ষার জন্যে তাঁকে কতটা প্রয়োজন সেটা দুর্যোধন ভালো করেই জানতেন। সত্যি কথা বলতে দ্রোণ নয়, ভীষ্ম কৌরবদের পক্ষে ছিলেন বলেই দুর্যোধন পান্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধটা করতে সাহস দেখেয়েছিলেন।

অন্নদাস তথা মার্সেনারিদের ভরসায় যুদ্ধ করা যায় না যখন প্রতিপক্ষ হয় পান্ডবদের মত পরাক্রমশালী। দ্রোণ একজন অতিমহারথি যোদ্ধা ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর আনুগত্য কৌরবদের পক্ষে কখনোই ছিল না। কথাটা হচ্ছে ভীষ্ম ইচ্ছে করলেই অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে পারতেন। সেটা না করে তিনি যেটা করেছেন সেটা অন্যায়। পাণ্ডবদের ইচ্ছে করলেই তিনি হত্যা করতে পারতেন কিন্তু পান্ডবদের প্রতি স্নেহবিষ্ঠ ছিলেন বলেনা তিনি পান্ডবদের বদলে অসংখ্য সাধারণ সৈন্যকে হত্যা করেছেন। যুদ্ধটাকে অকারণ রক্তক্ষয়ী করে তুলেছিলেন।

আপনারা অনেকেই হয়ত ভাবছেন - বাপু ! তুমি তো দেখছি ব্যাসদেবের চাইতেও বেশি বুঝতে শুরু করেছ। একটু অপেক্ষা করুন আমি এতক্ষন ধরে যা বলার চেষ্টা করছি সেটাকে প্রমান করার জন্যে আমার গান্ডীব থেকে মোক্ষম তুনটা এখনো বের করিনি। বিদুরকে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। সম্পর্কে কৌরব এবং পান্ডবদের পিতৃব্য এবং পেশায় হস্তিনাপুরের প্রধানমন্ত্রী। সেই অর্থে তিনি বিদুর একজন আউটসাইডার এবং ইনসাইডার দুটোই ছিলেন। পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে আউটসাইডার, আর পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে দেখলে একজন ইনসাইডার।

এঁকে ধর্মের প্রতীক বিবেচনা করা হত কারণ তিনি ধর্মরাজ যমের অবতার হয়েই ওই সময় হস্তিনাপুরে অবতীর্ন হয়েছিলেন। একথা তাঁর পিতা স্বয়ং ব্যাসদেবই বলেছেন। হস্তিনাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইনি কৌরবদের অন্নদাস ছিলেন। কিন্তু আপনারা কেউ বিদুরকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করতে দেখেছেন? দেখেননি - কারণ একজন অন্নদাস হওয়া সত্বেও তিনি সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন অধর্মের পক্ষে তিনি যুদ্ধ করবেন না।

আমি জানি আপনাদের মধ্যেও অনেক ঠ্যাঁটা লোক আছেন যারা বলবেন বিদুর যুদ্ধ-টুদ্ধ এসব কিছু তেমন জানত না - তাই বিদুরের বিশেষ একটা পক্ষ নেওয়া কোন গুরত্ব বহন করে না। ভুল! ভুল! সবই ভুল! যদি বিদুর যুদ্ধ-টুদ্ধ এসব একেবারে নাই জানতেন তাহলে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ, যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার হিসাবেই খ্যাত, তিনি বিদুরকে 'সরঙ্গ' নামের ধনুকটা উপহার দিয়েছিলেন কেন? কোন একটা পুঁথির পাশে সেই দিব্যাস্ত্রকে সাজিয়ে রাখার জন্যে?

দাসীপুত্র ছিলেন বলে পান্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদুর অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেননি এমন ভাবার ভাবার কোন কারণ নেই। অস্ত্রজ্ঞান তাঁর ভালোই ছিল কিন্তু সেটা তাঁর চর্চার বিষয় ছিল না। কিন্তু তাঁর পক্ষে নেয়া না নেওয়ার একটা গুরুত্ব অবশ্যই ছিল। যে যুক্তিতে ভীষ্ম কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করাটাকে ন্যায়সঙ্গত মনে করেছিলেন, সে যুক্তিকে বিদুর গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। হস্তিনাপুরের বেতনভুক কর্মচারী হওয়া সত্বেও তিনি অধর্মের পক্ষে তথা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেননি। এই খবর আমাদের স্বয়ং ব্যাসদেবই দিয়েছেন।

 

ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর: পলাশীর যুদ্ধের পূর্বাপর এবং কিছু প্রশ্ন । -
Guitar K Kanungo
Jan. 30, 2025 | category | views:45 | likes:1 | share: 0 | comments:0

পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে বাঙালীদের একটা আবেগের জায়গা আছে। বাঙালি নিজেদের একটা স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে চায়। অনেক বাঙালি মনে করে, পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের ফলে বাংলা এবং পরবর্তীতে এক সময় গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের অধীনে চলে গিয়েছিল। যদি পলাশীর যুদ্ধ না হত, যদি মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা না করতেন, যদি নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত না হতেন, তাহলে কি আমরা স্বাধীন থেকে যেতাম? আমাদের ইতিহাসটা হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হত, আমরা ব্রিটিশদের বদলে হয়ত ফরাসীদের উপনিবেশে পরিণত হতাম।  

মীর জাফর যে বেঈমানী করবেন, সেটা একরকম জানাই ছিল। এমনকি সেটা আলীবর্দি খাঁর সময়েই জানা গিয়েছিল। আলীবর্দী খান যে একজন ভালো প্রশাসক ছিলেন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু মীর জাফরের ক্ষেত্রে তিনি মস্ত বড় ভুল করেছিলেন। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যাবার পেছনে আলীবর্দী খানের ভূমিকাকেও অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। নইলে ইতিহাসকে যথাযথভাবে জানা হয় না। আবার, একথাও ঠিক যে বাংলা এক সুলতানী আমল ছাড়া অন্য কোনো সময়ে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ছিল না, সেটাও আমাদের মেনে নিতে হবে, যথাযথ ইতিহাসচর্চার খাতিরেই।

পলাশীর যুদ্ধটা যখন ঘটে, তখন আলীবর্দী খান মারা গিয়েছিলেন। সেইজন্য আলীবর্দী খাঁর দায়টা কোথায়, সেটা বুঝবার আগে একটি গল্প বলে নেয়া দরকার। একজন নারী কর্মচারী ক্যাশ থেকে অর্থ সরানোর অভিযোগে বরখাস্ত হলেন। সেই কর্মচারী সত্যিই একজন দুঃখী মানুষ ছিলেন। তাঁর স্বামী ছিল না; অসুস্থ সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার চালানোর জন্য তিনি দুই জায়গায় কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠানের মালিক সেটা জানতেন, তবুও তিনি কোনো রকমের দয়া দেখালেন না। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন—এবারই যে এই কাজটা সে প্রথম করেছে, এটা তিনি বিশ্বাস করেন না। সেইজন্য ওই নারী কর্মচারীকে তিনি দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দিতে রাজী ছিলেন না।

আলীবর্দী খাঁ এই ভুলটাই করেছিলেন। তিনি তখন নবাব, আর তাঁর অধীনে বেশ কিছু সংখ্যক মসনদার ছিলেন, যারা যুদ্ধ-বিগ্রহে সৈন্য সরবরাহ করতেন। আসলে তখনকার দিনে আজকের মতো নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না; সৈন্যরা ভাড়াটে হিসেবেই কাজ করতো। যারা এই সৈন্যদের যোগান দিতেন, তাদের মসনদার বলা হত। একবার আলীবর্দী খাঁকে জানানো হয়, সৈন্য সংখ্যা নিয়ে এক ধরনের দুর্নীতি চলছে। যত জন সৈন্য সরবরাহ করা হয়েছে বলে কাগজে-কলমে দেখানো হচ্ছে, আসলে ততজন সৈন্য সরবরাহ করা হয়নি, কিন্তু অর্থ ছাড় করা হয়েছে বেশি সংখ্যক সৈন্য দেখিয়েই। এবং এই কাজটা অনেকদিন ধরেই চলছিল। এই দুর্নীতির পেছনে যিনি ছিলেন, তিনি আর কেউ নন—স্বয়ং মীরজাফর। এই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পরেও, আলীবর্দী খাঁ মীরজাফরের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, পরে যখন সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন, তখনও মীরজাফর তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন।

এবার ইংরেজদের প্রসঙ্গে আসা যাক । ইতিহাসে ক্যালকাটা ব্ল্যাকহোল বলে একটা ঘটনার কথা আছে।  ১৭৫৬ সালের ২০শে জুন এই ঘটনাটি ঘটেছিল। ইংরেজদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৪৬ জন কারাবন্দির মধ্যে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল শ্বাসকষ্ঠ এবং ক্লান্তিতে ভুগে। এই সংখ্যাটির কথা বলেছেন এই ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মচারী জন হলওয়েল। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেক সাধারণ ইংরেজরাও এই ঘটনাকে অনেক বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে। ভারতীয়রা যে কতটা বর্বর এবং কেন এই বর্বর জাতিটাকে সভ্য করে তোলার দায়িত্ব তাদের নিতে হয়েছিল, সেই কারণটা যৌক্তিক করে তোলার ক্ষেত্রে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়।

আসলেই কি এতজন ইংরেজ সেদিন মারা গিয়েছিল? এই প্রশ্নটি উঠেছে, যেহেতু এই হিসাবটা পাওয়া গেছে ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের কাছ থেকে, সেহেতু এখানে অতিরঞ্জনের একটা সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক বীরেন কিশোর গুপ্ত "সিরাজুদ্দউলা এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি" নামের একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ লিখেছেন। সেই গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, এই সংখ্যাটি কোন অবস্থাতেই দশ থেকে পনেরো জনের বেশি নয়। অর্থাৎ জন হলওয়েল যে সংখ্যাটির কথা বলেছেন, সেটি আসল সংখ্যার চাইতে অন্তত দশ থেকে বারো গুণ বেশি।

কি ঘটেছিল সেদিন সেটা একটু এই ফাঁকে দেখে নেয়া যাক। নবাবের বাহিনীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ চলছিল তিন-চার দিন ধরে। শেষ পর্যন্ত সেই যুদ্ধে ইংরেজরা হেরে যায় এবং পরাজিত ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যেই আটকে রাখা হয়। এদিকে, কিছু ইংরেজ সৈন্য মদ খেয়ে মাতলামো করতে গিয়ে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করলে, যারা ঝামেলা করছিল তাদেরকে আলাদা করে রাখার আদেশ দেয়া হয় নবাবের তরফ থেকে।

এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, নবাবের তরফ থেকে যখন এই আদেশ দেয়া হয়, তখন নবাব সিরাজুদ্দৌলা কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ামে ছিলেন না। তিনি কলকাতাতেই ছিলেন, তবে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। এটা ঠিক যে, নবাবের সৈন্যরা বিশেষ কয়েকজন (যারা মাতলামি করছিল) ইংরেজ সৈন্যের উপর আগে থেকেই খেপে ছিলেন। সেই কারণে তারা কয়েকজন সৈন্যকে ঠেসে ঠুসে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেরকম কোনো আদেশ একেবারেই দেননি। ওই ঘটনায় কিছু ইংরেজ সৈন্য অবশ্যই মারা গিয়েছিল, কিন্তু সেই সংখ্যাটি কখনোই জন হলওয়েল যা বলেছেন, তা নয়।

গল্পের ফাঁকফোঁকর : কৃষ্ণের বিরুদ্ধে শিশুপালের সব অভিযোগই  কি মিথ্যে ছিল? -
Guitar K Kanungo
Jan. 26, 2025 | category | views:66 | likes:1 | share: 0 | comments:0

কৃষ্ণ কেবলমাত্র কংসের নয় আরো একজনের মৃত্যুর কারণ হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চেদিরাজ শিশুপাল। সম্পর্কে শিশুপাল আবার কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। শিশুপালের জন্মও কিছুটা অস্বাভাবিকই ছিল। তিনি তিনটি চোখ এবং তিনটি বাহু নিয়ে জন্মেছিলেন। ফলত তাঁর জন্মের পরপরই একটা দৈববাণী হয় যে যার হাতে তাঁর মৃত্যু হবে তিনি তাঁকে স্পর্শ করলেই তাঁর এই বাড়তি অঙ্গগুলো খসে পড়বে।

শিশুপাল যখন ছোট তখন কৃষ্ণ একবার তাকে কোলে নিতেই শিশুপালের এই বাড়তি অঙ্গগুলো খসে পড়ে। শিশুপালের কদর্যতা ঘুঁচলেও আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হল - সবাই জেনে গেল কৃষ্ণের হাতে শিশুপালের মৃত্যু হবে। কেউ যদি আগে থেকে জেনে যায় বিশেষ একজন মানুষের হাতে তাঁর মৃত্যু হবে তাহলে সে যেটা করতে চাইবে সেটা হল সেই মানুষটাকে হত্যা করা। যে চেষ্টাটা মথুরার রাজা কংস করেছিলেন।

কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন ওঠে যদি কারো মৃত্যু এভাবেই নির্ধারিত হয়ে থাকে - দৈৱিকভাবে - তাহলে সেটা এড়ানো কি আদৌ সম্ভব? মৃত্যু একদিন সবারই হবে।  বেশিরভাগ মানুষ সেটা জানে ; তারা কেবল এটা জানে না সেই মৃত্যুটা কখন হবে, এবং কার হাতে হবে। শিশুপাল এবং কংসের দুর্ভাগ্য তারা সেটা আগে থেকে জানতেন।

কংস সব রকমের চেষ্ঠা করেছিলেন তার ভবিষ্যত হত্যাকারীকে তিনি নিজে খুন হয়ে যাবার আগে খুন করে ফেলতে। যে কোন ক্ষমতাবান মানুষ সেটাই করবে এবং কংস সেটাই করেছিলেন ; কিন্তু তিনি যে উপায়ে কাজটা করেছিলেন সেই কাজটা যথযথ ছিল না। একটু বুদ্ধির পরিচয় দিলেই তিনি তার ভবিষ্যতকে বদলে দিতে পারতেন। দেবকী অরে বসুদেবকে কারাবন্দি করেছেন ভালো কথা কিন্তু তাদের একসঙ্গে থাকতে দিয়েই নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছেন। দেবকীকে রাজপ্রাসাদে রেখে বসুদেবকে কারাগারে আটকে রাখলেই সব ল্যাঠা চুকে যেত। তাহলে এই দম্পতির কোন সন্তানেরই জন্ম হত না, অষ্ঠম সন্তান তো অনেক পড়ের কথা।  


সেই দিক থেকে দেখলে শ্রুতশ্রবা বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। শ্রুতশ্রবা  সম্পর্কে শিশুপালের জননী, কৃষ্ণের পিসী। কৃষ্ণবর্ণের এই ভাইপোটার বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি আগাগোড়ায়  সচেতন ছিলেন। তিনি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন  করলেন।  তিনি জানতেন পুত্রের ভবিতব্যকে পরিবর্তন করার সাধ্য তাঁর নেই, কিন্তু চাইলে তিনি পুত্রের পরমায়ু বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন।  তিনি সেটাই করেছেন। কৃষ্ণকে দিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন শিশুপালের অন্তত একশ অপরাধ কৃষ্ণ ক্ষমা করবেন।    

একশটি অপরাধ খুব একটা কম কথা নয়। এমন নয় যে শিশুপালের সঙ্গে কৃষ্ণের মাসে একবার করে দেখা হচ্ছে। এমনও হয়েছে বছরের পর বছর কৃষ্ণের সঙ্গে শিশুপালের হয়ত কোন রকম দেখাই হয়নি। দেখা না হলে অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা থাকে না। এইভাবে দেখলে পুত্র শিশুপালের জন্যে একটা দীর্ঘ জীবনের ব্যবস্থা শ্রুতশ্রবা করে রেখেছিলেন। কিন্তু মানুষ যত চেষ্টাই করুক নিয়তিকে খণ্ডনের উপায় নেই। শিশুপাল নিজেই ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকল।

একথা ঠিক কৃষ্ণ তাঁকে একদিন হত্যা করবে এই তথ্যটা জানার পর মামাতো ভাই হলেও শিশুপাল কৃষ্ণকে সহজভাবে নিতে পারে নি। নিতে না পারারই কথা; বয়ঃপ্রাপ্ত হতেই শিশুপাল কৃষ্ণের বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে গিয়েই ভিড়ল। শুধু যে ভিড়ল তা নয় তাঁর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল বিদর্ভ রাজ্যের যুবরাজ রূক্ষ্মীর সঙ্গে এবং বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে  রূক্ষ্মীর বোন রুক্ষ্মিণীর সঙ্গে শিশুপালের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে গেল। বিধির বিধান! এদিকে রুক্মিণী কিন্তু ভালোবাসতেন শিশুপালের পরম শত্রু বাসুদেব কৃষ্ণকে। 

শেষ পর্যন্ত রুক্ষ্মিণীকে কৃষ্ণ অপহরণ করে নিয়ে গেলেন। বিদর্ভ রাজ্যের রাজা, কিংবা রাজকুমার অথবা সৈন্য সামন্তদের কিছুই করার থাকল না। কৃষ্ণের প্রতি শিশুপালের ঘৃণার পারদ কেবল আরেক দফা পারল। রাগে ক্ষোভে  শিশুপাল হয়ত বেশ কিছু গালাগাল দিয়ে ফেললেন কৃষ্ণকে - হতে পারে মনে মনে কিন্তু অপরাধ অপরাধই। কৃষ্ণ হিসাব রাখছেন কারণ তাঁর তরফে এটা একটা দায়িত্বও বটে।  তিনি কংস এবং কংসের সহযোগীদের দমন করার জন্যে এই ধরাধামে অবতীর্ন হয়েছেন। কংসও আত্মীয়, শিশুপালও আত্মীয় ; কিন্তু কৃষ্ণের উপায় নেই।    

মহাভারত আমাদের পরিষ্কার করে বলে নি শিশুপালের যে একশটা অপরাধ কৃষ্ণ ক্ষমা করেছেন সেই অপরাধ গুলো আসলে কী কী। আমরা শিশুপাল এবং কৃষ্ণকে একই আসরে উপস্থিত থাকতে দেখব যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। এর আগে অন্তত দুবার এই দুইজনের দেখা হয়েছিল। কৃষ্ণ যখন নরকাসুরকে বধ করতে যান তখন একবার কারণ সেই সময় শিশুপাল নরকসুরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন কৃষ্ণ রুক্মিনীকে অপহরণ করেন। আগেই বলা হয়েছে ওই বিয়ের আসরে শিশুপালই বর হয়ে এসেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আসরে সমস্যাটা শুরু হয়েছিল যখন ওই যজ্ঞের অর্ঘ্য কাকে দেয়া উচিত সেই প্রসঙ্গ উঠল। মহামতি ভীষ্ম কৃষ্ণকেই যোগ্য ব্যাক্তি হিসাবে মনোনীত করতেই শিশুপাল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। কৃষ্ণের ব্যাপারে তার এমনিতেই আক্রোশের শেষ নেই। তার উপর ভীষ্ম বলছেন সেই কৃষ্ণকেই সেই বিরল সম্মান দিতে যে সম্মানের যোগ্য কৃষ্ণ নন - অন্তত শিশুপাল সেটাই মনে করেন। এই নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় - এক পর্যায়ে শিশুপালের সমস্ত একশটি অপরাধ পূর্ণ হওয়া এবং কৃষ্ণের সুদর্শন চক্রের আঘাতে শিশুপালের দেহ থেকে মুন্ডু খসে যাওয়া।    

প্রশ্ন হচ্ছে শিশুপাল কী ভুল কিছু বলেছিলেন? ভীষ্ম কৃষ্ণকে যোগ্য মনে করেছেন অলৌকিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কিন্তু আমরা যদি ধরে নিই কৃষ্ণ কোন অবতারই ছিলেন, তিনি আর দশ জনের মত একজন সাধারণ মানুষ। তখন পর্যন্ত তাঁর একমাত্র সাফল্য কংসকে বধ করা। অবশ্য ইতোমধ্যে তিনি সেই সময়কার সবচাইতে পরাক্রমশালী মগধের রাজা জরাসন্ধকেও বধ করেছিলেন - তাও নিজে নয় ভীমকে দিয়ে এবং সেটা অনেকটা ছল করেই।

এদিকে কংসকে হত্যা করলেই কৃষ্ণ নিজে কখনো কোন রাজ্যের রাজা ছিলেন না, শিশুপাল একথাটাও মিথ্যা বলেননি। কংসকে হত্যা করবার পর কংসের পিতা উগ্রসেনেকেই মথুরার সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। আবার একথাও তো ঠিক জরাসন্ধের ভয়ে কৃষ্ণকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল - মথুরা থেকে সরে দ্বারকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। জরাসন্ধ বেঁচে থাকলে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা হয়ে উঠত না। জরাসন্ধ বিশেষ কোন কারণে যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করার অনুমতি দিলেই সেই যজ্ঞের অর্ঘ্য জরাসন্ধকেই অর্পণ করতে হত।


গল্পের ফাঁকফোঁকর : যিনি রিপুকেই দমন করতে পারলেন না তিনি আবার মহর্ষি হলেন কি করে? -
Guitar K Kanungo
Jan. 21, 2025 | category | views:65 | likes:8 | share: 0 | comments:0

দুর্বাসা মুনিকে চেনেন না, এমন পাঠক খুব কমই আছেন, বিশেষত তিনি যদি হিন্দুধর্মাবলম্বী হন। সীমাহীন ক্রোধ এবং যখন-তখন যাকে-তাকে অভিশাপ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত কুখ্যাত ছিলেন এই ঋষি। দেবতা-মানুষ, কেউই তাঁর ক্রোধের আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। এমনকি যিনি তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন, সেই বেচারা নারীটিও রক্ষা পাননি তাঁর ক্রোধের আগুন থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে মুনিঋষিদের সমস্ত ইন্দ্রিয় তাঁদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা, অনেকটা মহর্ষি বশিষ্টের মতো, দুর্বাসার ক্ষেত্রে উল্টোটাই হচ্ছে কেন? কেন তিনি নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ক্রোধের কারণেই কুখ্যাত হচ্ছেন? কেন এই বৈপরীত্য? অনেক ক্ষেত্রে কোন প্রকার ভাবনা-চিন্তা না করেই দুর্বাসা অভিশাপ দিয়ে দিচ্ছেন এবং তা ফলে যাচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে?

কে ছিলেন এই দুর্বাসা? ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ মতে, রুদ্র তথা শিবের অংশ থেকে দুর্বাসার জন্ম। একবার প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গে শিবের একটি বিষয়ে কথা কাটাকাটি হয়। শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন, এতটাই ক্রুদ্ধ হন যে দেবতাগণের তো দূরের কথা, স্বয়ং পার্বতীও শিবের ধারে কাছে আসতে পারছিলেন না। পার্বতী বললেন, এইভাবে চলতে থাকলে শিবের সঙ্গে তাঁর ঘর করা সম্ভব হবে না। এদিকে পার্বতীকে ছাড়া শিবের এক মুহূর্তও চলছিল না। শিব ক্রোধ সংবরণ করলেন। ঠিক এই সময়, সপ্তর্ষিদের একজন মহর্ষি অত্রির পত্নী অনুসূয়া সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন। শিবের বরপ্রাপ্তির ফলস্বরূপ, তাঁর প্রশমিত ক্রোধের সবটুকু নিয়েই অনুসূয়ার গর্ভে জন্ম নিলেন উগ্রতপা ঋষি দুর্বাসা। 

রুদ্রের অংশে জন্ম নিয়েছিলেন বলেই দুর্বাসার এত ক্রোধ—এই যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রথমত, মহর্ষি অত্রি এবং তাঁর স্ত্রী অনুসূয়া হয়তো শিবের মতো একজন পুত্র চেয়েছিলেন, সেটা হতেই পারে, কিন্তু সেই পুত্র প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে জন্মাবে এবং ত্রিভুবনে ব্যাপক ঝামেলা করবে, এটা নিশ্চয়ই তাঁরা চাননি। দ্বিতীয়ত, শিব যদি সাধ্বী অনুসূয়ার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েই তাঁকে পুত্রপ্রাপ্তির বর দিয়ে থাকেন, তাহলে নিজের জমে থাকা সমস্ত ক্রোধ সেই সন্তানের মধ্যে ভরে দেওয়া নিঃসন্দেহে সঠিক কাজ হয়নি। সমুদ্র মন্থনের পর যখন সমস্ত বিষ উঠে আসে, তখন তা নিজের কণ্ঠে ধারণ করে শিব নীলকণ্ঠ হন। একইভাবে, তিনি ক্রোধিত হতেই পারেন, কিন্তু সেই ক্রোধকে সংবরণ করার উপায় মহাদেবের অজানা ছিল, একথা বিশ্বাস করা কঠিন।

তাঁর এই ক্রোধের কারণে একজন মহাপ্রাণ তপস্বী হিসেবে যতটুকু সম্মান তাঁর পাওয়া উচিত ছিল, তা সবসময় যে তিনি পেয়েছেন, এমনটা বলা যাবে না। কোনো গৃহস্থের বাড়িতে তাঁর আগমন ঘটলে সেই গৃহস্থ তাঁকে সম্মান দেখাতেন বটে, কিন্তু সেই সম্মান মূলত ভয় এবং আতঙ্ক থেকেই। তাঁর ক্রোধের পাশাপাশি উদ্ভট সব আবদার গৃহস্থের নাভিশ্বাস উঠিয়ে দিত। শাস্ত্রে যদি ব্রাহ্মণ বধের অনুমতি থাকত, তবে দুর্বাসা হয়তো অনেক আগেই খুন হয়ে যেতেন।

দুটো ঘটনার কথা বলি।

একবার তিনি মহারাজ কুন্তিভোজের প্রাসাদে উপস্থিত হলেন এবং জানালেন, কিছুদিন সেখানে থাকবেন। তটস্থ কুন্তিভোজ হাত জোড় করে সম্মতি জানালেন। কিন্তু দুর্বাসা তো দুর্বাসাই; উপদ্রব না করলে তাঁর চলে না। তিনি কুন্তিভোজকে জানালেন যে যতদিন তাঁর প্রাসাদে থাকবেন, তাঁর আদর-আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কুন্তিভোজ ভেতরে ভেতরে ঘামতে শুরু করলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করার অঙ্গীকার করলেন।

দুর্বাসার থাকার ব্যবস্থা করা হলো; কন্যা কুন্তীকে তাঁর সেবায় নিযুক্ত করা হলো। কুন্তী বুঝলেন, মহাবিপদ। দুর্বাসা গভীর রাতে কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দলবল নিয়ে এটা-সেটা খেতে চাইছেন। দিন নেই, রাত নেই - এটা কর, ওটা কর ; এটা আন, ওটা আন।  কুন্তী শেষ পর্যন্ত সবদিক সামলে দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন। এর ফলস্বরূপ, কুমারী অবস্থায় কুন্তীর গর্ভে এক সন্তানের জন্ম হয়, যে সন্তানকে জন্মের পরমুহূর্তেই ত্যাগ করতে হয়েছিল। 

পরের ঘটনাটি স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে। রুক্মিণীর সঙ্গে বিয়ের পরপরই কৃষ্ণ ও রুক্মিণী একদিন দুর্বাসার আশ্রমে উপস্থিত হন তাঁর আশীর্বাদ গ্রহণের জন্য। দুর্বাসা খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করলেন। এক পর্যায়ে কৃষ্ণ-রুক্মিণী দুর্বাসাকে আমন্ত্রণ জানালেন দ্বারকায় আসার জন্য। দুর্বাসা রাজি হন, তবে শর্ত দেন যে কৃষ্ণ ও রুক্মিণীই তাঁর রথ টেনে নিয়ে যাবেন। আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছেন, তাই পিছিয়ে আসার উপায় নেই। কৃষ্ণকে বাধ্য হয়ে দুর্বাসার অন্যায় আবদারে রাজি হতে হয়।

দুর্বাসার ইচ্ছে অনুযায়ী, কৃষ্ণ ও রুক্মিণী রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে রুক্মিণী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লে কৃষ্ণ, রথ না থামিয়ে (পাছে দুর্বাসা অসন্তুষ্ট হন), পায়ের বুড়ো আঙুলের খোঁচায় মাটি ফুঁড়ে গঙ্গাকে বের করে আনেন। রাণী রুক্মিণী সেই জল পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন। তবে জল পান করার আগে রুক্মিণী কেন দুর্বাসাকে সেই জল নিবেদন করেননি, এই কারণে দুর্বাসা ক্রুদ্ধ হলেন এবং অভিশাপ দিলেন এই যুগলকে। সেই অভিশাপের ফলে রুক্মিণীকে অনেকটা সময় কৃষ্ণের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল।

এই অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধের কারণে দুর্বাসা অনেক সময় দুষ্টুলোকেদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। এবার অবশ্য বাসুদেব কৃষ্ণ দুর্বাসাকে একটি শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেবেন।

পাণ্ডবদের বনবাস চলছে। দুর্যোধন দুর্বাসাকে পাণ্ডবদের কাছে পাঠালেন আতিথ্য গ্রহণের জন্য, কারণ দুর্বাসার প্রায় দশ হাজার শিষ্য ছিল, যারা সর্বদা তাঁর সঙ্গে যেত। পাণ্ডবরা নিজেরাই কুটির বানিয়ে বনের ফলফুল আর পশুপাখি ধরে কোনোমতে জীবনধারণ করছিলেন। তাদের পক্ষে দশ হাজার মানুষকে আপ্যায়িত করা সম্ভব ছিল না। দুর্যোধন এই সুযোগটাই নিতে চেয়েছিলেন, যাতে দুর্বাসার ক্রোধ পাণ্ডবদের ওপর পড়ে এবং অভিশাপ নেমে আসে।

দুর্বাসা সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে শিষ্যদের বিশাল বহর নিয়ে হাজির হলেন পাণ্ডবদের কুটিরে। দ্রৌপদীর কাছে একটি জাদুকরী পাত্র ছিল, যেখান থেকে যেকোনো সংখ্যক মানুষকে খাওয়ানো যেত, তবে সেটি করা যেত দ্রৌপদীর খাদ্য গ্রহণের আগে পর্যন্ত। দুর্বাসা ঠিক সেই সময়ের পরে হাজির হয়েছেন, যখন দ্রৌপদী ইতিমধ্যেই খাওয়া শেষ করেছেন। দ্রৌপদী মহাবিপদে পড়লেন এবং প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। কৃষ্ণ এসে দ্রৌপদীর সেই পাত্রের তলায় পড়ে থাকা একটি ভাতের কণা মুখে পুরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেই স্নানরত দুর্বাসা এবং তাঁর শিষ্যদের সমস্ত ক্ষুধা মিটে গেল। তারা আর দ্রৌপদীর কুটিরের দিকে না এসে পালিয়ে গেলেন

এই ঘটনার মধ্যে কিছুটা অলৌকিকতার উপাদান আছে। কৃষ্ণা স্মরণ করতেই কৃষ্ণ চলে এলেন—এ রকম কিছু আসলে ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। দুর্বাসা পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার এই পালিয়ে যাওয়ার পেছনে কৃষ্ণ নয়, পাণ্ডবদের কোনো এক ভাইয়ের ভূমিকা ছিল—খুব সম্ভবত ভীমের। শাপ-টাপ এসব নিয়ে ভীমকে কখনো খুব একটা পরোয়া করতে দেখা যায়নি। পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে একমাত্র ভীমই দ্রৌপদীকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতেন। দ্রৌপদীর জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। এখানেও হয়তো ভীম দুর্বাসাকে এমন কিছু একটা বলেছেন, কিংবা এমন ভয় দেখিয়েছেন যে দুর্বাসা বাপ্ বাপ্ বলে পালিয়ে গেছেন। 

প্রাণের ভয় দুর্বাসারও আছে।  পরের ঘঠনায় সেটা প্রমাণিত হবে। 

সেই সময় অম্বরীষ নামের একজন রাজা ছিলেন। রাজা অম্বরীষ ভগবান বিষ্ণুর এতটাই ভক্ত ছিলেন যে বিষ্ণু তাঁকে তাঁর সুদর্শন চক্র ব্যবহার করার অনুমতি দেন। মহারাজ অম্বরীষ একবার এক যজ্ঞের আয়োজন করেন এবং দেবতাদের আমন্ত্রণ জানান। যজ্ঞ শেষে অম্বরীষ উপবাস ভঙ্গের উপক্রম করলে দুর্বাসা তাঁকে অপেক্ষা করতে বলে স্নান করতে যান। দুর্বাসার ফিরতে দেরি হলে অম্বরীষ অন্যান্য ঋষিদের অনুমতি নিয়ে সামান্য জল মুখে দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। কিছুক্ষণ পর দুর্বাসা ফিরে আসেন এবং জানতে পারেন যে অম্বরীষ তাঁর জন্য অপেক্ষা না করেই উপবাস ভঙ্গ করেছেন। এতে দুর্বাসা অভিশাপ দিতে উদ্যত হন। এই অবস্থায় অম্বরীষ সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করেন। সুদর্শন চক্র এসে দুর্বাসাকে তাড়া করতে থাকে। উপায় না দেখে দুর্বাসা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের কাছে গিয়ে সুদর্শন চক্রের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ত্রিদেব তাঁদের অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ভগবান বিষ্ণু বলেন, একমাত্র অম্বরীষই সুদর্শন চক্রকে ফিরিয়ে নিতে পারেন। দুর্বাসা আবারো অম্বরীষের কাছে হাজির হন। কথায় কথায় আর কখনো কাউকে অভিশাপ দেবেন না—এই শর্তে অম্বরীষ সুদর্শন চক্রকে ফিরিয়ে নেন।

সেই থেকে দুর্বাসা ঋষিকে আর কোথাও দেখা যায়নি। রিপুকেই দমন করতে পারলেন না বলেই কি তাঁর এই অধঃপতন হয়েছিল?  


গল্পের ফাঁকফোঁকর: মহাভারতে কি মাল্টিভার্সের কথা বলা আছে? -
Guitar K Kanungo
Jan. 19, 2025 | category | views:71 | likes:4 | share: 4 | comments:1

তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের ধারণা, আমাদের মহাবিশ্ব ছাড়া আরও অনেক মহাবিশ্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। এই প্রতিটি মহাবিশ্ব যেখানে আমাদের মতো একাধিক সৌরজগৎ আছে, কিন্তু আলাদা সব বৈশিষ্ট্য এবং নিয়ম মেনে চলছে। তবে এই মাল্টিভার্স তত্ত্বটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়, তবে এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। কল্পবিজ্ঞানে মাল্টিভার্স নিয়ে নানান গল্প আছে। দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল তার মধ্যে একটি। দ্য লং আর্থ সেরকম আরেকটি উপন্যাস, যেখানে লেখক বলছেন মানবসভ্যতা এরকম এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে প্রবেশ করার কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছে। তারা এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছে, যেটা দিয়ে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে যাওয়া আসা করছে।

এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যশোয়া ভ্যালেন্টের মধ্যে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে যাবার সহজাত ক্ষমতা আছে। হিন্দু পুরাণে এরকম একজন চরিত্রের দেখা পাওয়া যায়। পুরাণে তো আছেনই, মহাভারতেও তিনি আছেন। তিনি দেবর্ষি নারদ। মথুরার দেবকী এবং বসুদেবের বিয়ে শেষ হয়েছে। দেবকীর ভাই কংস মহাসমারোহে বোন এবং বোনের স্বামীকে রথে বসিয়ে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময় নারদ এসে হাজির হন, অনেকটা যশোয়া ভ্যালেন্টের মতোই  নারদ বলেন এই যুগলের অষ্টম সন্তানের হাতেই কংসের মৃত্যু হবে। শুরু হবে অন্য এক গল্পের। যে ঢেঁকির মতো দেখতে যন্ত্রটায় নারদ চড়ে বেড়ান, সেটা কি যশোয়া ভ্যালেন্টের 'স্টেপার' যেটার মাধ্যমে সে এক মহাবিশ্ব থেকে আরেক মহাবিশ্বে চলাচল করছে?

পার্বতী অন্দর মহলের প্রাইভেসি রক্ষা করার জন্য একজন দ্বারপাল তৈরি করলেন। "তৈরি" শব্দটা ব্যবহার করতে হচ্ছে কারণ যিনি দ্বারপাল নিযুক্ত হলেন, তিনি স্বয়ং বিনায়ক গণেশ। যেহেতু পার্বতীই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন, অতএব গণেশ কেবল পার্বতীকেই মা বলে জানেন। মুশকিলের ব্যাপার হল, মায়েদের যে স্বামী থাকে, এবং তাদেরকে যে বাবা বলে ডাকা হয়, এবং মা'দের প্রাইভেসি বিনষ্ট করার অধিকার বাবাদের সবসময়ই থাকে—এই তথ্যটা গণেশের জানা ছিল না। মহাদেব কার্যোপলক্ষে বাইরে ছিলেন। কৈলাসে ফিরে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হলেন মহাদেব। গণেশ তাঁকে ঢুকতে দিলেন না, কারণ মা কাউকে ঢুকতে দিতে বারণ করেছেন। এই "কাউকে"র মধ্যে যে শিব পড়েন না, সেটা পার্বতী পরিষ্কার করে বলেননি। ফলে শিব বাড়ি ঢুকতে না পেরে ভুত-প্রেতদের সঙ্গে গাঁজার আসর জমালেন। একটা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলো, এরকম অবস্থায় দেবর্ষি নারদ থাকবেন না—সেটা কী হয়! তিনি ঢেকিতে চড়ে হাজির হলেন। ফলে অনেক জল ঘোলা হল এবং এক পর্যায়ে গণেশের মাথা শিবের হাতে কাটা পড়ল। এর পরের কাহিনী প্রায় সবারই জানা। বলবার বিষয় হল, এখানেও নারদ আসছেন, আসতে পারছেন অনায়াসে। শিবের কৈলাস; এটা ব্রহ্মলোক, অমরাবতী নয়, বৈকুণ্ঠও নয়।

দেবর্ষি নারদ পিতামহ ব্রহ্মারই পুত্র। অর্থাৎ, তাঁর জন্ম হয়েছে ব্রহ্মলোকে। কিন্তু ব্রহ্মলোকে জন্ম হলেও তিনি সেখানে থাকেননি। তিনি ঢেরা বেঁধেছেন বৈকুণ্ঠে, যেখানে ভগবান বিষ্ণু অবস্থান করেন। ভগবান বিষ্ণুর স্তব করেই তাঁর সময় কাটে। সেই স্তব কঠিন মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে নয়; তিনি গানে গেয়ে বিষ্ণুর অর্চনা করেন। কথিত আছে, তানসেন গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারতেন। দেবর্ষি নারদ ছিলেন তার চাইতেও বড় সংগীতজ্ঞ। কতটা বড়? তার একটা নমুনা দেওয়া যেতে পারে। একবার নারদ তাঁর আরাধ্য দেবতাকে উদ্দেশ্য করে বীণায় এমন সুর ধরলেন যে, ভগবান বিষ্ণুর শ্রীচরণ গলে এক জলের ধারা সৃষ্টি হয়ে ত্রিভুবন ভাসিয়ে নেবার উপক্রম হল। আশুতোষ সেই জলের ধারাকে নিজের জটায় ধারণ করে সৃষ্টি রক্ষা করলেন। শিবের জটা থেকে সেই নদীকে মর্ত্যলোকে নামিয়ে আনবেন রাজা ভগীরথ। সেই থেকে গঙ্গা ভাগীরথী নামেই পরিচিত হবেন। ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, কৈলাস আর মর্ত্যলোক সব একাকার হয়ে গেল।

এতক্ষণ বলতে চাইলাম, হিন্দু পুরাণে মাল্টিভার্সের এরকম উল্লেখ অসংখ্যবার করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণের মহাবিশ্ব কেবল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেমন গ্রিকদের আছে কিংবা আব্রাহামিক ধর্মগুলো বিশ্বাস করে। হিন্দু পুরাণে স্বর্গ আছে, কিন্তু সেটা দেবতাদের আবাস—মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই, অতীতের দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। নরকের আদলে যমলোক একটা আছে, কিন্তু সেখানে মৃত ব্যক্তির আত্মা পরবর্তী জন্মের জন্য অপেক্ষা করে মাত্র। হিন্দু পুরাণে এর বাইরেও অনেক লোক বা জগতের কথা বলা হয়েছে। ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, শিবলোক—এর কোনোটিই স্বর্গের অংশ নয়। এগুলো সবই আলাদা আলাদা জগৎ, এবং এইসব জগতে যাওয়া আসার ক্ষমতা বিশেষ কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নারদ তাদের একজন। মহাভারতে অর্জুনকে একবার সশরীরে স্বর্গে যেতে দেখা যায়, অবশ্য তবে তাঁকে নেবার জন্য তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্র রথ পাঠিয়েছিলেন। সেই রথটা কি বিশেষ কোনো মহাকাশ যান, অথবা যশোয়া ভ্যালেন্টের স্টেপার? তবে মহর্ষি ভৃগু কোন পদ্ধতিতে ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুলোক, এবং শিবলোকে ভ্রমণ করছিলেন, সেই তথ্য মহাভারতের কবি দেননি।

তবে আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা মাল্টিভার্স তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে যে সমস্ত দিক নিয়ে চিন্তা করছেন—অর্থাৎ, এক মহাবিশ্বের সঙ্গে আরেক মহাবিশ্বের সময়ের যে একটা তফাৎ থাকতে পারে, সেটা কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাস কিন্তু ধারণা দিয়েছেন। কতটা জেনে বা বুঝে তিনি এটা তুলে ধরেছেন, বলা মুশকিল। তবে আধুনিক কালের কল্পবিজ্ঞানের লেখকরা এই তথ্যটা জানলে বেশ পুলকিত হতেন, কারণ মহাভারত রচিত হয়েছে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। মহাভারতে উল্লেখিত ঘটনাটার কথা বলি। সত্যযুগে রৈবত কুকুদ্মী নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর এক সর্বগুণসম্পন্ন কন্যা ছিল—নাম রেবতী। তিনি রেবতীর জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজছিলেন। খুঁজতে গিয়ে মনে হলো প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছেই যাওয়া যাক, তিনি হয়তো একটা ভালো পাত্রের সন্ধান দিতে পারবেন।

তাঁর সেই অনুযায়ী কন্যা রেবতীকে নিয়ে রাজা কুকুদ্মী ব্রহ্মলোকে হাজির হলেন। যে মুহূর্তে কুকুদ্মী ব্রহ্মলোকে হাজির হয়েছিলেন, ঠিক তখন ব্রহ্মা এক সংগীতের আসরে মগ্ন ছিলেন। চমৎকার সব সংগীত পরিবেশিত হচ্ছিল একের পর এক। ব্রহ্মা পঞ্চমুখে বলছিলেন, "তোফা! তোফা!" কুকুদ্মী এবং রেবতীও সেই গানের আসরে যোগ দিলেন। একপর্যায়ে গান শেষ হল। কুকুদ্মী যথাবিহিত সম্ভাষণপূর্বক প্রজাপতি ব্রহ্মাকে তাঁর আসার কারণ জানালেন। সব শুনে ব্রহ্মা বললেন, "দ্বাপরযুগে মথুরায় ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণ হয়ে জন্ম নেবেন। তাঁর বড় ভাই বলদেবই হবেন রেবতীর উপযুক্ত পাত্র।" রাজা কুকুদ্মী কিছুক্ষণ বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলেন। তিনি জন্মেছেন সত্যযুগে,  ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়েছেন ব্রহ্মলোকে, আর ব্রহ্মা কিনা তাঁর মেয়ের পাত্র দেখছেন দ্বাপরযুগে জন্ম নেবে এমন একজনকে ! ব্রহ্মা অন্তর্যামী। তিনি মুখ টিপে হাসছিলেন কুকুদ্মীর দুরবস্থা দেখে। বললেন, " পৃথিবীর সময় আর ব্রহ্মলোকের সময় এক নয় - মহারাজ ! আপনি পৃথিবীতে ফিরে গেলেই দেখতে পাবেন দ্বাপর যুগ অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, আপনার রাজ্যে কেউ বেঁচে নেই । বলদেব অনেক আগেই জন্ম গ্রহণ করছেন। বলরামের  সঙ্গে আপনার কন্যা রেবতীর বিয়ে দিন। "

ব্রহ্মদেবের কথা মিথ্যা হয়নি। এটা কি মাল্টিভার্স তত্বকে প্রতিষ্টা করে সেরকম একটা উপাখ্যান নয়? ভবিষৎ এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।    


ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর: একজন কামুক রাজার গল্প । -
Guitar K Kanungo
Jan. 15, 2025 | category | views:58 | likes:5 | share: 2 | comments:0

শাহজাহান সত্যিই মুমতাজ মহলকে ভালোবাসতেন। আর্জুমান্দ বানু বেগমের (মুমতাজ মহল) সঙ্গে যখন শাহজাদা খুররমের (পরে তিনি সম্রাট শাহজাহান নামে পরিচিত হবেন) বিয়ে হয়, তখন আর্জুমান্দ বানু বেগমের বয়স ছিল উনিশ বছর এবং শাহজাদা খুররমের বয়স বিশ বছর। অর্থাৎ তাঁরা প্রায় সমবয়সী ছিলেন।

আটত্রিশ বছর বয়সে তাঁদের পঞ্চদশতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মুমতাজ মহল মৃত্যুবরণ করেন। উনিশ বছরে পনেরো বার গর্ভধারণ! অর্থাৎ প্রতি ১.২৫ বছরে মুমতাজ মহল একবার করে গর্ভধারণ করেছেন। এই বিষয় থেকেই বোঝা যায়, এই দম্পতির মধ্যকার শারীরিক ভালোবাসা যথেষ্ট তীব্র ছিল।

মুমতাজ মহলের মৃত্যুতে শাহজাহান খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। বেশ কয়েক দিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের একটি নিয়ম ছিল, সম্রাট প্রতিদিন সকালের দিকে একবার জনসাধারণকে দর্শন দেবেন। এর উদ্দেশ্য ছিল এই বার্তা দেওয়া যে সম্রাট বেঁচে আছেন এবং যা কিছু ঘটছে, তা সম্রাটের নির্দেশেই ঘটছে। স্ত্রী-বিয়োগের ফলে শাহজাহান অনেক দিন ধরে চলে আসা সেই প্রথাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো তাঁর হয়ে সেই সময় রাজ্য পরিচালনা করছিলেন।

এক পর্যায়ে তাঁর মাথায় তাজমহল নির্মাণের ভাবনা এলো। তিনি নিজেই এই সমাধি সৌধের ডিজাইন করেন। ভেতরের কিছু নকশার কাজ করালেন ইতালীয় এক নকশাদারকে দিয়ে। এই নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত থাকলেন। একসময় তৈরি হলো শাহজাহানের আকাঙ্ক্ষিত রওজায়ে মুনাভারা, যা পরবর্তীতে তাজমহল নামে পরিচিতি পায়।

হিন্দু মন্দির ভেঙে তাজমহল তৈরি করা হয়েছে—এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। পুরুষোত্তম নাগেশ ওক নামের এক স্বঘোষিত ঐতিহাসিক এই ধারণাটি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একথা ঠিক যে আকবর এবং জাহাঙ্গীরের সময় ছাড়া বাকী মুঘল সম্রাটদের রাজত্বকালে এখানে-ওখানে কিছু মন্দির ভাঙা হয়েছে। সেই সময় এমন আইনও প্রচলিত ছিল যে মুঘল সাম্রাজ্যের ভেতরে নতুন করে কোনো মন্দির নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু কোনো মন্দির ভেঙে তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল—এই ব্যাপারটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। পুরুষোত্তম নাগেশ ওক তাঁর দাবির সপক্ষে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হাজির করতে পেরেছেন কিনা, তা আমার জানা নেই।

ব্যাপারটি স্রেফ এতটুকুই যে জায়গাটির ওপর তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল, সেখানে রাজা মানসিংহের একটি প্রাসাদ ছিল। সম্পর্কে রাজা মানসিং ছিলেন শাহজাহানের মামা। রাজপুত যোধাবাঈ ছিলেন শাহজাহানের জননী, আর মানসিং ছিলেন যোধাবাঈয়ের ভাই। (যোধাবাঈ আকবরের স্ত্রী ছিলেন—এই তথ্যটি সত্য নয়।) মাতুলের দেওয়া জমির ওপর তিনি প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন। যেহেতু এই জায়গাতেই আগে থেকেই প্রাসাদ ছিল এবং সেই প্রাসাদে রাজপুতরা বসবাস করতেন, সেখানে কোনো একজন বা একাধিক হিন্দু দেবতার মন্দির হয়তো ছিল। তবে সেটি ছিল নিতান্তই পারিবারিক। সোমনাথ মন্দিরের মতো সর্বজনীন কোনো মন্দির সেখানে ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আমরা কিছুটা মূল আলোচনা থেকে দূরে সরে গেছি। আমরা শাহজাহান এবং মুমতাজের ভালোবাসার গল্প বলতে চাইছিলাম। শাহজাহানের শারীরিক ভালোবাসার প্রতি তীব্র আকর্ষণ ছিল, একথা আমি আগেই বলেছি। এই দিক থেকে দেখলে তাঁকে রাজা যযাতির সঙ্গে তুলনা করা চলে। তাঁর জীবনটাও—অন্তত জীবনের শেষ অংশটাও—এক অর্থে যযাতির মতোই এ টেল অফ লাস্ট

তিনিও যযাতির স্টাইলে জরা বিনিময় করতে না পারলেও দীর্ঘ সময় যৌবন ধরে রাখার জন্য নানাবিধ উত্তেজক ওষুধ গ্রহণ করতেন। এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তিনি মাঝে মাঝে অসুস্থও হয়েছেন। তবুও তাঁর অবাধ যৌনাচার থেমে থাকেনি। শুধু তাই নয়, রাজকন্যা জাহানারাও যে আলাদাভাবে এমন অবাধ যৌনাচারের আয়োজন করতেন, ঐতিহাসিকরা সেই ব্যাপারে একমত।

বড়সড় হারেমের জন্য মুঘলদের আগাগোড়াই খ্যাতি ছিল। সেখানে সুন্দরী, যৌবনবতী, আবেদনময়ী নারীর কমতি ছিল না। কিন্তু শাহজাহানের তাতেও মন ভরত না। তিনি প্রাসাদের ভেতরেই মীনাবাজার বসাতেন। রাজধানীর নানা বয়সী নারীরা সেখানে পসরা সাজিয়ে বসতেন। শাহজাহান সেইসব স্টলে ঘুরে ঘুরে দেখতেন। বিশেষ কোনো পসরা নয়, তিনি দেখতেন পসরা সাজিয়ে বসা নারীদের। কোনো নারীকে তাঁর পছন্দ হলেই দেহরক্ষীদের ইশারা করতেন। এরপর সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী তাঁদের সম্রাটের সেবায় নিযুক্ত করা হতো।

সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়টি ছিল, এই কাজটি দেখাশোনা করতেন তাঁরই কন্যা জাহানারা। তিনি কি এই সমস্ত নারীদের মধ্যে মুমতাজকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন? হয়তো তাই। যদিও ঐতিহাসিকদের কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তবে শাহজাহান যে একজন নিম্ফোম্যানিয়াক ছিলেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। যে স্ত্রীকে তিনি এত ভালোবাসতেন, যাঁর জন্য তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম সমাধি সৌধ নির্মাণ করেছেন, তাঁর শারীরিক মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি আবার নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েন।

ভালোবাসা বিষয়টি বড়ই অদ্ভুত—কখন, কোথায় গিয়ে পড়ে, কোথায়, কীভাবে প্রকাশ পায়, তা বলা মুশকিল।

গল্পের ফাঁকফোঁকর: কে বড়— রাধা নাকি রুক্মিণী ; কৃষ্ণ, নাকি বিষ্ণু? -
Guitar K Kanungo
Jan. 13, 2025 | category | views:55 | likes:3 | share: 4 | comments:0

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ঈশ্বর নিজেকে তিনভাবে প্রকাশ করেন: সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, এবং ধ্বংসকর্তা। সৃষ্টি করেছেন ব্রহ্মা, পালন করেন বিষ্ণু, এবং ধ্বংস করেন শিব। এইভাবে প্রকাশের মধ্যে একটি সমস্যা আছে। সেটি হল—সৃষ্টি করার পর ব্রহ্মার আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। সেইজন্যেই বোধ হয় ব্রহ্মার কোনো মন্দির নেই; তাঁকে কেউ পূজা করে না। এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হবার এক মুহূর্ত আগে শিব আবির্ভূত হলে খুব একটা অসুবিধা হবে না, কারণ ধ্বংস করা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো কাজ নেই।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, পালনকর্তা বিষ্ণুই সার্বভৌম—একেবারে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রয়োজন রয়েছে মর্ত্যের মানুষের কাছে। মর্ত্যে কংসের মতো বা বালির মতো কারো বাড় বেড়ে গেলে, এই বিষ্ণুকেই ধরাধামে অবতীর্ণ হতে হয় পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করার প্রয়োজনে। কিন্তু, আবার একথাও তো ঠিক—ব্রহ্মা যদি সৃষ্টিই না করতেন, তাহলে বিষ্ণুর সেই সৃষ্টিকে রক্ষা করারই প্রয়োজন হত না; শিবের ধ্বংস করারও। তাহলে, ব্রহ্মাই কি শ্রেষ্ঠ? নাকি বিষ্ণু? নাকি শিব? কে বড় ত্রিমূর্তির মধ্যে?

এই প্রশ্নটাই মহর্ষি ভৃগুর মনেও জেগেছিল। তিনি শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মা বা শিব নয়, ঈশ্বরের তিন প্রধান প্রকাশের মধ্যে বিষ্ণুকেই শ্রেষ্ঠ বলে রায় দিয়েছিলেন। ভৃগু বিষ্ণুর এই শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেছেন নম্রতার মাপকাঠি দিয়ে। ভৃগু এর আগে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং দেবাদিদেব মহাদেবকেও পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। কিন্তু নম্রতার মানদণ্ডে এদের দুজনের কেউই উত্তীর্ণ হতে পারেননি।

বুকে পদাঘাত করার পরেও বিষ্ণু ভৃগুকে কোনো শাস্তি দেননি; বরং পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে তাঁকে বরণ করে নিয়েছেন। এই গল্পটা সম্ভবত ব্যাস আমাদের শুনিয়েছেন মহাভারতে। অবশ্য, এখানে কিছুটা পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারও থাকতে পারে। কোনো কোনো পুরাণ বলে ভগবান বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী মহর্ষি ভৃগুরই আত্মজা। কন্যার স্বামীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকতেই পারে, বিশেষত সে স্বামী যদি ভগবান বিষ্ণু হন। যদি হিমালয়কে এই দায়িত্ব দেওয়া হত, তিনি নিশ্চিত চাল-চুলোহীন শিবকেই বেছে নিতেন।

কিন্তু, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ আমাদের ভিন্ন কথা বলছে। সেখানে কৃষ্ণই হচ্ছেন সবকিছুর মূল। তিনিই পরমব্রহ্ম। সৃষ্টির ইচ্ছাও তাঁর মধ্যেই প্রথম প্রকট হয়েছিল—বিষ্ণুর মধ্যে নয়। কৃষ্ণই নিজেকে একজন পুরুষ এবং একজন নারীতে বিভক্ত করে রমনে লিপ্ত হলেন। এই রমনের ফলে নারী অংশটি গর্ভবতী হয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে একটি গোলাকার পিণ্ড প্রসব করেন। সোনালী রঙের এই পিণ্ডটিই আমাদের মহাবিশ্ব। অনেক বছর সেই পিণ্ড ভেসে থাকল। তারপর একদিন সেই পিণ্ডটি ভেদ করে বিষ্ণু বেরিয়ে এলেন এবং সৃষ্টিকর্মের বাকিটা শেষ করলেন।

এখানে ব্রহ্মার কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না; মহাদেবের অস্তিত্বেরও উল্লেখ নেই। স্পষ্টতই কৃষ্ণই সবকিছুর মূল।

মহাভারত বলছে বাসুদেব কৃষ্ণ ভগবান বিষ্ণুর অবতার। মহাভারত আরও বলছে—তাঁর একাধিক স্ত্রী থাকলেও রুক্মিণীই কেবল লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। এদিকে, মথুরায় আসার আগে কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবনে ছিলেন, সেখানে চুটিয়ে প্রেম করেছেন শ্রীমতি রাধার সঙ্গে এবং অন্যান্য ব্রজবালাদের সঙ্গেও।

মজার ব্যাপার, রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমটা স্বকীয়া ছিল না। রাধা বিবাহিত ছিলেন এবং বয়সে কৃষ্ণের চেয়ে কিছুটা বড় ছিলেন। কৃষ্ণ কেবল রাধাতেই মজে ছিলেন না; অসংখ্য ব্রজবালার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। এই সমস্ত ব্রজবালার অনেকেই বিবাহিত ছিলেন। রাধা এই নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছুটা মান-অভিমান করলেও কৃষ্ণের বহুগামিতা নিয়ে রুক্মিণীর মতো তিনিও নিস্পৃহ ছিলেন।

কিন্তু রাধা একজন সাধারণ গোপী। তিনি লক্ষ্মীর অংশে জন্ম নেননি। মজার ব্যাপার হল, কৃষ্ণ নাম উচ্চারিত হলেই রাধার নামই আসে; রুক্মিণীর নয়। তাই, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে—রাধা আর রুক্মিণীর মধ্যে কে বড়?

কেউ কেউ বলবেন, যিনিই কৃষ্ণ, তিনিই বিষ্ণু; যিনি ব্রহ্মা, তিনিই শিব। সবকিছু মিলেই এক এবং অদ্বিতীয় পরমব্রহ্ম। তাঁরা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেন। শুনেছি বটে এরকম কথা। ত্রিমূর্তিকেও মাঝে মধ্যে ধ্যান করতে দেখা গেছে। তাঁরা হয়ত এই পরমব্রহ্মেরই স্তব করেন। ব্রহ্মা করেন ব্রহ্মলোক থেকে, শিব করেন কৈলাস থেকে, আর বিষ্ণু করেন বৈকুণ্ঠ থেকে। যেহেতু এঁদের তিনজনেরই আলাদা আলাদা আবাস আছে, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করার পর ব্রহ্মার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই, ধরে নেওয়া যায় ব্রহ্মা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেই চলেছেন।

আর শিব? তিনি কি এই মুহূর্তে কোনো কাজে ব্যস্ত? নাকি তিনিও ধ্যানমগ্ন? সেই সম্ভাবনা কম। কারণ পার্বতী কিছুতেই এই বন্দোবস্ত মেনে নেবেন না। তুমি গৃহী হবে আবার সাধনাও করবে—এ দুটি কাজ একসঙ্গে তো চলতে পারে না!

যাই হোক, আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই পরমব্রহ্ম কোথায় থাকেন? গোকুলে? কৃষ্ণ গোকুলেই বেড়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই কি বলা হয়, কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম?শুনেছি বটে এরকম কথা।

ত্রিমূর্তিকেও মাঝে মধ্যে ধ্যান করতে দেখা গেছে। তাঁরা হয়ত এই পরমব্রহ্মেরই স্তব করেন। ব্রহ্মা করেন ব্রহ্মলোক থেকে, শিব করেন কৈলাস থেকে, আর বিষ্ণু করেন বৈকুণ্ঠ থেকে। যেহেতু এঁদের তিনজনেরই আলাদা আলাদা আবাস আছে, এবং যেহেতু সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করার পর ব্রহ্মার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নেই, ধরে নেওয়া যায় ব্রহ্মা এই পরমব্রহ্মকেই স্তব করেই চলেছেন।

আর শিব? তিনি কি এই মুহূর্তে কোনো কাজে ব্যস্ত? নাকি তিনিও ধ্যানমগ্ন? সেই সম্ভাবনা কম। কারণ পার্বতী কিছুতেই এই বন্দোবস্ত মেনে নেবেন না। তুমি গৃহী হবে আবার সাধনাও করবে—এ দুটি কাজ একসঙ্গে তো চলতে পারে না!

যাই হোক, আরেকটি গুরুতর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই পরমব্রহ্ম কোথায় থাকেন? গোকুলে? কৃষ্ণ গোকুলেই বেড়ে উঠেছিলেন। সেই জন্যেই কি বলা হয়, কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম? কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম?

গল্পের ফাঁকফোঁকর : অলৌকিকতা নাকি বুজরুকি? -
Guitar K Kanungo
Jan. 12, 2025 | category | views:78 | likes:3 | share: 0 | comments:0
অলৌকিকতা ছাড়া সম্ভবত  সব ধর্ম অর্থহীন। ঈশ্বর অলৌকিক তো বটেই, যারা সেই ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে আসেন তাদের অনেক কর্মকান্ড ও  অলৌকিক। এই সমস্ত অলৌকিক কর্মকান্ডকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা না গেলেও এসব ধর্মে যার আস্থা স্থাপন করেছে তারা এই ঘটনাগুলোকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করে। ব্রিটিশ গণিতবিদ জন সি লেনক্স তাঁর "ক্যান সাইন্স এক্সপ্লেইন এভরিথিং" গ্রন্থে যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন বিজ্ঞান কি সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে? পারে না - বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু আবার একথাও তো ঠিক আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে বিজ্ঞান যা ব্যাখ্যা করতে পারত না, এখন সেটা পারে। আগামী পাঁচশ বছর পরে এমন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবে যেটা ঠিক এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করতে পারছে না।  

পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর এমন কিছু ঘটনার কথা আমাদেরকে শোনানো হয়েছে যেগুলো যেসময় ঘটেছে বলে জানানো হয়েছে, সেই সময় ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করা না গেলেও এখন কোনো রকম প্রশ্নের উদ্রেক না করেই সেগুলো ব্যাখ্যা করা যায়। ধারণা করা হয়, প্যালিওলিথিক যুগে (প্রায় ১,০০,০০০ থেকে ৩০,০০০ বছর আগে) প্রথম মানুষের ধর্মবিশ্বাস বিকশিত হয়েছিল। এই সময়ে মানুষের মধ্যে অতিপ্রাকৃত অনুভূতির প্রকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। নৈমিত্তিকভাবে ঘটে চলা অনেক ঘটনাই সেই সময়ের মানুষের কাছে অলৌকিক মনে হত, যেহেতু সেই সমস্ত ঘটনার কারণ তাঁদের জ্ঞান এবং বুদ্ধির অগম্য ছিল। কিন্তু সেই সমস্ত ঘটনাগুলোকে তারা অলৌকিক মনে করলেও, এই সমস্ত ঘটনার পেছনে একজন (বা একাধিক) ঈশ্বর আছেন—সেই ধারণা পাকাপাকিভাবে তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অর্গানাইজড রিলিজিয়নগুলো আসার পর থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে এবং ধর্মের প্রয়োজনকে বৈধতা দিতে গিয়ে এই সমস্ত ঘটনাকে অত্যন্ত সুকৌশলে সাধারণ মানুষের মনোজগৎকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ধর্মই একাজ করেছে।

ইহুদি ধর্মের আলোচনা দিয়ে শুরু করা যাক। মুসাকে একজন মেসায়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলো মুসার লোহিত সাগরের পানি দুই ভাগে ভাগ করে একটি চলার পথ সৃষ্টি করা। এই পথ দিয়েই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে সাগর পার হয়ে ইসরায়েলের পথে যাত্রা করেছিলেন। লেনক্স যত কথাই বলুক, সাগরের পানিকে মাঝ বরাবর দুই ভাগ করা সম্ভব নয়—এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব নয়। ঈশ্বর নিজেও প্রকৃতির নিয়মের কাছে সীমাবদ্ধ; ইচ্ছা করলেই সেই নিয়ম ভাঙা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে এক ধরণের নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। ঈশ্বর সেটা চাইবেন না, যদি আলোচনার খাতিরে এটা ধরে নিই যে ঈশ্বরের সেই ক্ষমতা আছে। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কি এই গোটা ঘটনাটাই বানোয়াট? আসলে এরকম কিছু ঘটেনি? সেই সম্ভাবনাই বেশি—আসলেই কিছু ঘটেনি। বাইবেলের রচয়িতা এখানে জুল ভার্নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তফাৎটা এই যে, জুল ভার্ন স্বীকার করেছেন তিনি কল্পবিজ্ঞান লিখছেন, বাইবেলের রচয়িতা সেকথা স্বীকার করেননি।

যীশুকে ঘিরে সবচাইতে অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনাটি হলো ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যবরণ করার কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর পুনরুত্থান; এই ব্যাপারটা খ্রিস্ট ধর্ম বিশ্বাসের অন্যতম প্রধান মূলনীতিও বটে। অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি যদি যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে খ্রিস্টধর্মের প্রতি তার ভক্তি অচল নয়। বাইবেল বলছে, যীশুকে শুক্রবারে কবরস্থ করা হয়েছিল এবং তিনি কবরস্থ হওয়ার তৃতীয় দিনে, অর্থাৎ রোববারে পুনরুত্থিত হয়েছেন। এরপর চল্লিশ দিন তিনি এই ধরাধামেই ছিলেন। বিভিন্ন শিষ্যদের দর্শন দিয়েছেন, তবে সবার আগে যীশুর দর্শন পেয়েছেন মেরি—তাঁর মা মেরি নন, শিষ্য মেরি। শিষ্যদের নানান উপদেশ-আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি সশরীরে স্বর্গারোহন করেছেন। দুজন ফেরেশতা তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করেছেন, অর্থাৎ তাঁকে স্বর্গে তুলে নিয়ে গেছেন।

এরকম স্বর্গারোহনের ঘটনা আমরা আরো অন্তত দুটি ক্ষেত্রে ঘটতে দেখব। প্রথমটা মহাভারতে ঘটেছিল পাণ্ডবদের ক্ষেত্রে, দ্বিতীয়টা ইসলামের নবী মুহাম্মদের মেরাজের ক্ষেত্রে। বর্ণনা শুনে মনে হয়, স্বর্গ—তথা যে স্থানে ঈশ্বর বসবাস করেন সেটা অন্তরীক্ষের কোন এক স্থানে। ফলস্বরূপ, তাঁদের দুজনকে ঊর্ধ্বপথেই যেতে হয়েছিল, যদিও আমরা ঠিক নিশ্চিত নই, স্বর্গটা আসলে কোথায়। যীশুর ক্ষেত্রে, দুইজন ফেরেশতা এসে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মুহাম্মদের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বাহন ব্যবহার করা হয়েছিল। সেটার যে শারীরিক বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা কোন অবস্থাতেই একটি স্পেসশিপের নয়। যীশুর স্বর্গারোহন সেই অর্থে অনেকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন, যদিও তিনি আদৌ পুনরুত্থিত হয়েছিলেন কিনা, সেই প্রশ্নটা এখনো রয়েই গেছে। পান্ডবদের স্বর্গারোহন করার ব্যাপারটা ছিল আরো হাস্যকর। তাঁরা পায়ে হেঁটে স্বর্গের পথে রওয়ানা দিয়েছিলেন, যে পথ অতিক্রম করতে হলে হিমালয় পর্বত পার হতে হয়। হিমালয়ের কৈলাস পর্বত শিবের আবাস, কিন্তু সেটা স্বর্গ নয়। তাহলে হিমালয়ের ওপারে কোথাও পান্ডবদের স্বর্গ কি, তিব্বত কিংবা চীনের কোথাও? বলা মুশকিল।

এবার যীশুর পুনরুত্থানের আলোচনায় ফেরা যাক। ক্রুশবিদ্ধ করার আগে এবং ক্রুশবিদ্ধ থাকা অবস্থায় যে শারীরিক নির্যাতন যীশু সহ্য করেছেন, তাতে তিনি যে মৃত্যবরণ করেছেন, এই ব্যাপারটা নিশ্চিত—বিজ্ঞানসম্মতভাবেই নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে তাঁকে জীবিত দাফন করা হয়েছে, এমন ভাবার কোন সুযোগ নেই। যদি জীবিত দাফন করা না হয়ে থাকে, তাহলে মৃত্যুর তিন দিন পরে তাঁর আবার কবর থেকে বেরিয়ে আসারও কোন সুযোগ নেই। মৃত্যুর মোটামুটি দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে মানব শরীরে রিগর মর্টিস শুরু হয়ে যায়। মৃত্যুর বায়াত্তর ঘণ্টা পরে, তাঁর সুস্থ শরীরে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। এখানে আরো একটা মনে রাখা দরকার, যারা বলছেন পুনরুত্থানের পর তাঁরা যীশুকে দেখেছেন, এদের কেউই নিরপেক্ষ সাক্ষী নন। এদের সবাই যীশুর শিষ্য এবং অনুরাগী। যীশুকে একজন মেসাইয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা উদগ্র ইচ্ছা এদের মধ্যে থাকতে পারে।

ইসলাম ধর্মের প্রচারক মুহাম্মদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার একটির কথা আগেই বলা হয়েছে। একটা ঘোড়া সদৃশ প্রাণীর পিঠে চড়ে অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করে আসার গল্প কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়। এই ঘটনার একটাই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হতে পারে, আর সেটা হল, তিনি গোটা ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখেছেন। সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। মুহাম্মদের ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলা হয়েছে, যেটাকে অনায়াসে অলৌকিক বলা চলে। বলা হয়, জিব্রাইল ফেরেশতা এসে মুহাম্মদের বুক চিরে বুকের ভেতর থেকে কিছু কালো জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনেন। তারপর মুহাম্মদের হৃৎপিন্ডটাকে বুক থেকে বের করে এনে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে, সেটাকে আবার যথাস্থানে বসিয়ে দেন। মুসলমানদের কাছে এই ঘটনা সাক-আল সদর নামে পরিচিত। এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছে মুহাম্মদেরই কিছু সমবয়সী খেলার সাথী। মুহাম্মদের বয়স তখন চার বছর, এবং তাঁর খেলার সাথীদের বয়সও এর কাছাকাছি ছিল।

এই ঘটনার বর্ণনা শুনে সবার আগে যে প্রশ্নটা মনে উদিত হয়, সেটা হল, চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ কতটা গ্রহণযোগ্য। তারা নিশ্চয়ই, যদি এই ঘটনা ঘটে থাকে, গোটা ঘটনাকে দূর থেকে দেখেছে। তাহলে তারা কিভাবে বুঝতে পারল যে, যিনি এই কাজটি করছেন, তিনি জিব্রাইল? এদের কেউ কি জিব্রাইলকে আগে দেখেছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারা কিভাবে বুঝল, মুহাম্মদের বুক চিরে যে বস্তুটা বের করে আনা হয়েছে, সেটা হৃৎপিন্ড নাকি কলিজা? মরুভূমিতে বেড়ে ওঠা কিছু বাচ্চা, যাদের মানব শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে কোন ধারণা থাকার কথা নয়, তারা গড়গড় করে বলে যাচ্ছে জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনা হয়েছে, হৃৎপিন্ড পরিশোধন করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এটাও বলছে, সেই হৃৎপিন্ড আবার জমজমের পানি দিয়ে ক্লিন করা হচ্ছে। এইসব শিশুরা কিভাবে বুঝল, ওটা জমজমের পানিই ছিল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নয়? জিব্রাইল কি তাহলে ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন? পুরো ঘটনাটির বর্ণনা আধুনিক সময়ের ওপেন হার্ট সার্জারির কথাই মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু খোল আকাশের নিচে কোন রকম 'অ্যানেস্থেশিয়া' ব্যবহার না করে এরকম ভাবে ওপেন হার্ট সার্জারি করা কি যায়?  বিশেষত যখন ড. দেবী শেঠীর মত হার্ট সার্জন যেখানে তখনো জন্মাননি। গোটা ব্যাপারটাই হাস্যকর রকমের কষ্টকল্পিত।

শুরুতেই বলেছিলাম, এরকম বুজরুকি সব ধর্মেই আছে। হিন্দু ধর্ম তার ব্যতিক্রম নয়, হতেও পারে না। নাদিয়ার মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের মহাপ্রয়াণের কথাই ধরা যাক। বৈষ্ণবরা তো বটেই, বৈষ্ণব নন এমন অনেকে হিন্দুও একথা বিশ্বাস করেন যে, মহাপ্রভু পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। অলৌকিকতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা। কোন জীবিত মানুষের পক্ষে একটি মাটির কিংবা পাথরের তৈরি বিগ্রহ মূর্তির সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মহাপ্রভু ভগবান বিষ্ণুর অবতার লীলা সম্পন্ন করে তিনি আবার জগন্নাথের মধ্যেই আবারো বিলীন হয়ে গেছেন, অনুসারী ভক্তদের কাছে মহাত্ব্যপূর্ণ করে তোলার জন্যেই যে ব্যাপারটাকে এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সেইজন্যেই, অনেকেই যেমন কোন রকমের যুক্তির ধার ধারে না গিয়ে গোটা ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করেছে, তেমনি যুক্তিবাদী মানুষরা যুক্তিহীন এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যানও করেছে। শেষোক্ত মানুষেরা মনে করে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে আসলে খুন করে তাঁর মৃতদেহ এই মন্দিরের জগন্নাথ বিগ্রহের পেছনে (অথবা অন্য কোথাও) লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

এই সমস্ত অলৌকিক ঘটনাকে সাড়ম্বরে তুলে ধরার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনে ঈশ্বর বা কোনো উচ্চতর শক্তির প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাশীল করে তোলা। অলৌকিক ঘটনা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এমন কিছু দেখানোর চেষ্টা করে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ফলে, যারা ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে এক ধরনের রহস্যময় ধারণার জন্ম হয়। ঈশ্বরের মহিমা, ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সেই উচ্চতর শক্তির কাছে প্রণত হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যে ব্যাপারটাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না, সেই ব্যাপারটাকে অযৌক্তিক জেনেও বিশ্বাস করতে বলা, যে নৈতিকতা বিরোধী, সেকথাটা অনেক সময় যারা এইভাবে বিশ্বাস করতে বলেন, তাদের মনে থাকেনা। অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই যুক্তিযুক্ত, সেটাই সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত—এমনকি ঈশ্বর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও। ঈশ্বর যদি আমার আনুগত্য চান, তাহলে তিনি যে আছেন সেটা প্রমাণ করার দায়ভারটা একান্তই ঈশ্বরের। অযৌক্তিক অলৌকিকতা বুজরুকিরই নামান্তর।


গল্পের ফাঁকফোঁকর : গ্রাহাম গ্রীন কি মহাভারত পড়েছিলেন ? -
Guitar K Kanungo
Jan. 11, 2025 | category | views:29 | likes:2 | share: 1 | comments:0
এই প্রশ্নটা প্রথমে শুনতে অবান্তর শোনাবে কিন্তু গ্রাহাম গ্রীনের একটা উপন্যাসে আলোচিত একটা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব তখন আর সেরকম মনে হবে না। শুরুতেই গ্রাহাম গ্রীন সম্পর্কে কিছুটা বলে নিই।
গ্রাহাম গ্রীন ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। সাহিত্য সমালোচকরা বলে থাকেন তাঁর সাহিত্যকর্মে মূলত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব, নৈতিকতার প্রশ্ন, এবং মানুষের মানসিক টানাপোড়েনের প্রতিফলন দেখা যায়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে "দ্য পাওয়ার অ্যান্ড দ্য গ্লোরি", "দ্য হার্ট অব দ্য ম্যাটার", "দ্য কুইয়েট আমেরিকান", এবং "দ্য এন্ড অব দ্য অ্যাফেয়ার"। "দ্য টেন্থ ম্যান" তার একটি উল্লেখযোগ্য ছোট উপন্যাস, যেখানে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের নৈতিক দ্বিধা ও আত্মত্যাগের বিষয়গুলি গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই শেষের উপন্যাসটা অর্থাৎ "দ্য টেন্থ ম্যান" নিয়েই আমাদের আলোচনা।
এই উপন্যাসটি নিয়ে চলচ্ছিত্র নির্মিত হয়েছে। এন্থনি হপকিন্স কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। মূলত এই ছবিটা দেখেই আমার মধ্যে গ্রাহাম গ্রীন মহাভারত পড়েছেন কিনা প্রশ্নটা জেগেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়। জ্যাঁ-লুই শাভেল অধিকৃত ফ্রান্সের প্যারিস শহরের একজন ধনী আইনজীবী। একজন সেনা জার্মান কর্মকর্তাকে খুন করার অভিযোগে শাভেল যে শহরে বসবাস করতেন সেই শহরের কিছু পথচারীকে জার্মান বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এই মানুষগুলো কোনভাবেই ওই সেনা কর্মকতা হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না কিন্তু জার্মানবাহিনী অধিকৃত ফরাসি দেশের মানুষকে একটা শিক্ষা দিতে চাইছিল। এই তুলে নিয়ে যাওয়া মানুষদের মধ্যে ঘটনাচক্রে জ্যাঁ-লুই শাভেলও ছিলেন।
আইনজীবি এবং আর্থিক অবস্থার কারণে জ্যাঁ-লুই শাভেল নিজেকে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ বলে মনে করতেন। মনে করার কারণও একটা অসংগত নয়। তাঁর তখনকার দিনের হিসাবে বেশ ভালো পরিমানের অর্থ ব্যাংকে জমা রাখা ছিল। তিনি থাকতেন ছোটখাট একটা প্রাসাদের মত বাড়িতে। যাইহোক, জার্মান বাহিনী তাঁর সামাজিক অবস্থান নিয়ে কোন রকমের আগ্রহই দেখালো না। তাঁকে অন্যসব সাধারণ পথচারীর সঙ্গে কারারুদ্ধ করে রাখা হল। শুরুতে কিছুটা অসুবিধা হলেও জ্যাঁ-লুই শাভেল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হলেন।
কিছুদিন পর জার্মান বাহিনীর তরফে একজন সেনা কর্মকর্তা ওই কারাগার পরিদর্শনে এলেন। এসেই বললেন সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে পরের দিন তাঁদের ভেতর থেকে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হবে। বন্দিরা নিজেরাই যেন ঠিক করে নেয় কারা হবে সেই তিনজন। বন্দিদের মধ্যে একজন ছিল বয়সে বেশ কিছুটা প্রবীণ। তিনি বললেন তাঁর জীবনে খুব একটা বেশি সময় এমনিতেই নেই। তিনি তিনজনের একজন হতে রাজী হলেন। কিন্তু বাকী দুজন? অন্যদের মধ্যে কেউ যে মরতে চায় না। জ্যাঁ-লুই শাভেল তো নয়ই। কিন্তু উপায় কী ?
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল একটা লটারীর ব্যবস্থা করা হোক। যতজন কারাবন্দী আছে ততটা ছোট ছোট কাগজের টুকরো জোগাড় করা হল। সেই টুকরোগুলোর কেবল তিনটেতে এক্স চিহ্নটি লিখে সবগুলি কাগজে একসঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হল যাতে কীয় বুঝতে না পারে কোন কাগজে এক্স চিহ্নটি দেয়া আছে। এরপর সবাইকে একটি একটা কাগজের টুকরো তুলতে বলা হল। যে তিনজন এক্স চিহ্নিত কাগজ তুলবে সেই তিনজনই পরের দিনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকবে। যে বুড়ো শুরুতেই প্রাণ দেয়ার জন্যে রাজী হয়েছিল তার ভাগ্যে এক্স চিহ্নিত কাগজই জুটল। আর জুটল জ্যাঁ-লুই শাভেলের ভাগ্যে যিনি কোন অবস্থাতেই মরতে চাইছিলেন না।
ঠিক এই জায়গায় এসে আমার মহাভারতে বর্ণিত মহারাজ যযাতির কথা মনে পড়ে গেল। যযাতির স্ত্রী ছিলেন অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী। এই দেবযানীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠেছিলেন ঘটনাচক্রে তাঁর দাসীতে পরিণত হওয়া অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। যযাতি কামুক পুরুষ ছিলেন। শর্মিষ্ঠা দাসী হলেও রাজকন্যা ; তার উপর যযাতির চোখ পড়ল। শর্মিষ্ঠার তরফেও খুব একটা আপত্তি ছিল না। কিন্তু দেবযানীর ভীষণ রকমের আপত্তি ছিল - সঙ্গতকারণেই। অতএব দক্ষের মেয়েদের মত দেবযানী ছুটে গেলেন পিতা শুক্রাচার্য্যের কাছে স্বামী যযাতির বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে। শুক্রাচার্য্যের অভিশাপ নেমে এলো যযাতির উপর- তিনি জরাগ্রস্থ হবেন।
যযাতির মত কামুক একজন রাজার কাছে জরাগ্রস্থ হওয়া মৃত্যুরই সামিল। তিনি স্বশুরমশাইয়ের হাতে ধরে একটা উপায়ের ব্যবস্থা করলেন। তিনি চাইলে অন্য কারো সঙ্গে তাঁর জরা বদল করতে পারবেন। তিনি কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর সঙ্গে তাঁর জরা বদল করে আরো বেশ কিছু সময় যৌবনকে উপভোগ করে গেছেন। তারপর পুরুর কাছ থেকে জরা ফিরিয়ে নেন। বিনিময়ে অন্যপুত্রদের বঞ্চিত কে তিনি পুরুকেই তাঁর রাজ্যের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।
জ্যাঁ-লুই শাভেল ঠিক এই কাজটাই করলেন। তিনি মরতে চান না কোনভাবেই কিন্তু তার ভাগ্যে এসে পড়েছে এক্স চিহ্নিত কাগজের টুকরো। তিনি যযাতির মত ঘোষনা দিলেন কেউ যদি তার কাছ থেকে ওই কাগজের টুকরো নিয়ে নিজে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় তাহলে তাঁকে তিনি এক লক্ষ ফ্রাংক দেবেন। কেউ রাজী হলো না। শেষে তিনি তাঁর জীবনের মূল্য আরেকটু বাড়ালেন। বললেন তাঁর বাড়ী এবং ব্যাঙ্কে সঞ্চিত অর্থের বিনিমিয়ে কীয় তাঁর সাথে এই ডিল করতে চায় কিনা।
এক তরুণ এই প্রস্তাবে রাজী হল। তার এমনিতেই সহায় সম্পত্তি বিশেষ কিছু নেই। মৃত্যকে বেছে নিয়ে সে তাঁর বিধবা মা এবং একমাত্র বোনের জন্য একটা বাড়ী আর বেশ কিছু অর্থ অন্তত রেখে যেতে পারবে। যযাতির কনিষ্ঠ পুত্র পুরুও কি পিতার জরা গ্রহণ করতে গিয়ে একথাটা ভেবে দেখেনি ? নিশ্চয়ই দেখেছে। পুরুর অন্য ভাইরা পিতার ইচ্ছেয় সম্মতি না দিয়ে নিজেদের ভবিষতের গোড়ায় জল ঢেলে দিয়েছে ইটা না বোঝার মত বুদ্ধি পুরুর ছিল না এমন ভাবার কোন কারণ নেই। সেইজন্যে ভাবছিলাম গ্রাহাম গ্রীন কি মহাভারত পড়ে এই ধারণাটা পেয়েছিলেন ?
ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর : শাহজাদা সেলিম রাজা ইডিপাসের পথেই এগুচ্ছিলেন। -
Guitar K Kanungo
Jan. 10, 2025 | category | views:65 | likes:4 | share: 2 | comments:0

মুঘল সম্রাটদের মধ্যে আকবর সবচাইতে বেশী সময়ের জন্য রাজত্ব করেছিলেন  প্রায় পঞ্চাশ বছর তিনি ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। মোটা দাগে তিনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে মাত্র দুজন শাসকের নামের আগে 'মহান' শব্দটি যোগ করা হয়। একজন সম্রাট অশোক, আরেকজন সম্রাট আকবর। এদের প্রথম জন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে কাজ করেছিলেন, দ্বিতীয় জন একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মানের। একজন মুসলামন শাসক হওয়া সত্বেও আজ থেকে পাঁচশ বছরের কাছাকাছি সময়ের আগে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার কথা ভাবা সহজ ব্যাপার নয়, যেখানে আজকের দিনে এসেও অনেক মুসলমানের মধ্যে খেলাফত প্রতিষ্ঠার তীব্র আকুতি দেখতে পাওয়া যায়

এখানে দুটো বিষয় আমাদের বোঝা দরকার। আকবর নিরক্ষর হলেও মোটেই অশিক্ষিত ছিলেন না। তিনি বরং অন্য মুঘল সম্রাটদের তুলনায় অনেক বেশী পরিমানে শিক্ষিত, আসলে বলা উচিত অনেক বেশী সুশিক্ষিত ছিলেন। তাঁর বিশাল সংগ্রহের ব্যাক্তিগত লাইব্রেরী ছিল। তিনি নিজে পড়তে পারতেন না বলে অন্যরা তাঁকে সেসমস্ত বই পড়ে শোনাতেন। আকবরকে নিয়ে আরেকটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যেটা মূলত মুসলমান ঐতিহাসিকরা ছড়িয়েছে। বলা হয় তিনি দ্বীনে এলাহী নামের একটা ধর্মের প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। এই ব্যাপারটা সর্বৈব মিথ্যা।  দ্বীনে এলাহী নামের একগুচ্ছ প্রবিধি (code of conduct) তিনি প্রচলন করেছিলেন কিন্ত যেগুলো কেবল যারা শাসনকার্যের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্যেই প্রযোজ্য ছিল। তিনি আলাদা করে কোন বিশেষ ধর্ম প্রচার করেননি। তবে একথা ঠিক তিনি সব ধর্মের শাস্ত্রবিদদের ডেকে পাঠাতেন এবং তাঁদের কথা শুনতেন।  ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতিই অনুগত ছিলেন।

অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক এবং অনেকে ভারতীয় মুসলামনও  বলার চেষ্ঠা করেন মুঘলরা ভারতবর্ষে স্রেফ লুটপাট করার জন্য আসেনি, তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য এসেছিলেন। এই কথাটা আকবরের আগেকার মুঘল সম্রাট বাবুর এবং হুমায়ূনের  জন্যে সর্বাংশে সত্য ছিল না। তাঁদের মধ্যে পিছুটান ছিল। বিশেষত বাবুরের মধ্যে তো ছিলই, ভারতবর্ষের আবহাওয়া তাঁর কখনোই ভালো লাগেনি। মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট আকবরই সত্যিকার অর্থে প্রথম বারের মত কোন রকমের পিছুটান ছাড়াই একজন ভারতীয় হয়ে ওঠার চেষ্ঠা করেছিলেন। কাবুল কিংবা সমরখন্দ নিয়ে তাঁর কোন পিছুটান ছিল না।  

এবার আনারকলির গল্পটা বলি। গল্পটা প্রেমের হলেও, এই গল্পের পরিণতি অত্যন্ত মর্মান্তিক। আনারকলি পরিণতি সম্পর্কে যে ধরণটা প্রচলিত আছে সেটি হলো সম্রাট আকবর তাঁকে জীবন্ত হত্যা  করার আদেশ দিয়েছিলেন। সেই হত্যাটা কিভাবে করা  হয়েছিল  সেটা নিয়ে নানান মতমত থাকলেও সবচাইতে প্রচলিত ধারণটা ছিল আকবর আনারকলিকে চার দেয়ালের মধ্যে পুরে দিয়ে তাকে জীবন্ত অবস্থায় হত্যার নির্দেশ দেন। তবে, কিছু ইতিহাসবিদ এটাও মনে করেন আকবর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আনারকলিকে কোনো এক দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন সেখানে আনারকলি জীবনের বাকিটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন। শেষেরটা হবার সম্ভাবনাই বেশী। 

আনারকলির অপরাধটা কী? আনারকলির অপরাধ তিনি প্রেমে পড়েছিলেন এবং তিনি প্রেমে পড়েছিলেন আকবরের পুত্র শাহজাদা সেলিমের। এটাই কী তার অপরাধ ? ইতিহাস থেকে জানা যায় আকবর এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি, শুধু যে মেনে নিতে পারেননি  তা নয়, তিনি আনারকলিকে সেলিমের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার সব চেষ্টাই করেছেন। কিভাবে করেছেন সেকথা একটু আগেই বলেছি। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? এমন তো কোন কথা ছিল না শাহজাদার প্রেম করার কোন অধিকার ছিল না। পুরোদমেই ছিল। তাহলে?

আনারকলি হিন্দু ছিলেন নাকি মুসলমান এই ব্যাপারটা নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু জানা যায় না। হিন্দু বলে আকবর সেই সম্পর্ক মেনে নেননি, এরকম ভাবার খুব একটা সুযোগ নেই কারণ আকবর নিজেই হিন্দু রমনী বিয়ে করেছেন। শাহজাদা সেলিমের জননী যোধাবাঈ নিজেও ছিলেন একজন রাজপূত নারী - তথা হিন্দু ধর্মের অনুসারী । সেক্ষেত্রে আনারকলি হিন্দু হলেও আকবরের তরফে কোন রকমের আপত্তি থাকার কথা ছিল না। সমস্যাটা ছিল আসলে অন্য জায়গায় এবং সেটা গুরতর - যে জায়গাটা নিয়ে ইতিহাস অনেকটাই নীরব - বিশেষ কিছু বলে না।      

আকবরের সেলিমের বাইরে আরো দুজন  সন্তান ছিল। তাদের একজনের নাম দানিয়েল। আগেই বলেছি সালিমের মা ছিলেন যোধাবাঈ যদিও সেই মায়ের সঙ্গে সালিমের সম্পর্ক কখনোই খুব একটা ভালো ছিল। সেলিম বৈরাম খানের বিধবা স্ত্রী যাঁকে আকবর পরবতীতে বিয়ে করেছিলেন সেই রমণীকে নিজের মা বলে মনে করতেন এবং তাঁর সঙ্গেই বেশী ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যাই হোক, দানিয়েলের মা ছিলেন হারেমেরই আরেক নারী। আকবরের রাণীদের কেউ নন।  তিনি ছিলেন আকবরের হারেমের রক্ষিতাদের একজন। ঐতিহাসিক আব্রাহাম ইয়ার্লির মতে আনারকলিই ছিলেন দানিয়েলের মা।

সম্পর্কের এই বিশেষ জটিলতার কারণেই শাহজাদা সেলিম, যিনি কিনা সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরাধিকারী, আনারকলির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখুক আকবর সেটা চাননি।  


গল্পের ফাঁকফোঁকর: ভীষ্ম কি আসলেই ততটা মহান যতটা মহান তাঁকে ভাবা হয় ? -
Guitar K Kanungo
Jan. 9, 2025 | category | views:53 | likes:5 | share: 3 | comments:0

আমরা পিতামহ ভীষ্মকে যতই মহৎ বলি না কেন তাঁকে দিয়ে ব্যাস মোটা দাগে দুটো অপরাধ করিয়েছেন। দুটো অপরাধই বড় রকমের অপরাধ। এই দুটো অপরাধ এমন যে এই অপরাধগুলো সংঘটিত না হলে কুরুক্ষত্রের যুদ্ধটাই হত না।

ভীষ্মের প্রথম অপরাধ করেছেন গান্ধারী এবং তাঁর পরিবারের সাথে। তিনি গান্ধারীকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গান্ধার থেকে তুলে এনেছেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্যে। এই পর্যন্ত যদিও মেনে নেয়াও যায় কিন্তু এর পরে তিনি যে কাজটা করেছেন, সেটা পুরোপুরি ক্ষমার অযোগ্য। তিনি গান্ধারের রাজা সুবল, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের আরো কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনকে হস্তিনাপুরে ডেকে এনে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। শুধু তাই নয় ভীষ্ম এটাও নিশ্চিত করেছেন এরা সবাই যেন না খেতে পেয়ে মৃত্যবরণ করে।

ব্যাপারটা কতটা অমানবিক সেটা বোঝা যায় যদি আমরা গোটা ব্যাপরটাকে গান্ধারীর দিক থেকে দেখি। গান্ধারী ওই  রাজ্যের রাণী অথচ তিনি জানেনই না যে রাজপ্রাসাদে থাকছেন সেই রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও কোন এক কারাগারে তাঁর বাবা-মা-ভাই বন্দি এবং তারা না খেতে পেয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত, এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে কেবল  গান্ধারীর ভাই শকুনিই রেহাই পেয়েছিলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের কোন প্রয়োজন ছিল না। একথা ঠিক গান্ধার রাজ সুবল, বিশেষত, শকুনী বোনের এই বিয়েতে একেবারেই রাজী ছিল না। কিন্তু তাদের কোন উপায়ও ছিল না। হস্তিনাপুরের মত প্রতাপশালী রাজ্যের বিরুদ্ধে কিছু করার মত সামর্থ্য এবং সাহস কোনটাই তাদের ছিল না। বিয়ের আগে মুহূর্তে শকুনি যদি কিছু বলেও থাকেন সেটা অক্ষমের অসুফলন ছাড়া কিছুই নয়। ভীষ্ম অযথাই একটা গণহত্যা চালিয়েছেন। গণহত্যা এইজন্যে যে শকুনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত গান্ধারে ফিরে যায় নি। রাজা সুবল হস্তিনাপুরের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন। হতে পারে গান্ধার অত্যন্ত ছোট একটা রাজ্য কিন্তু সেখানেও তো কিছু মানুষের বসবাস ছিল।  রাজার অবর্তমানে তাদের কি দশা হয়েছিল মহাভারতের রচয়িতা আমাদের সেই খবর দেননি। 

ভীষ্ম দ্বিতীয় অপরাধটি করেছেন কাশীর রাজকন্যা অম্বাকে ফিরিয়ে দিয়ে। গান্ধারীর মতই কাশীর তিন রাজকন্যাকে তিনি তুলেই এনেছেন। এক্ষেত্রেও কাজটা তিনি গায়ের জোরেই করেছেন। স্বয়ম্বর সভা চলছে; যিনি বিয়ে করতে ইচ্ছুক তিনি স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত থাকে। ভীষ্ম নিজে বিয়ে করবেন না কিন্তু তিনি রাজকন্যাদের তুলে নিয়ে আসলেন  ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য। এই কাজটা তিনি জোরপূর্বক না করে বিচিত্রবীর্যকেই কাশীতে পাঠাতে পারতেন। বিচিত্রবীর্য নিজের ক্ষমতাবলে কাশী রাজকন্যাদের জয় করতে পারলে ব্যাপারটা অনেক শোভন এবং গ্রহণযোগ্য হত।  ভীষ্ম নিশ্চয়ই জানতেন বিচিত্রবীর্যের পক্ষে সেই কাজটা সম্ভব নয়। সেইজন্যে দায়িত্বটা তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এবং গোটা ব্যাপারটাকে লেজে গোবরে ছেড়ে দিলেন।

 অম্বা সৌভ্য দেশের রাজার শল্যকে ভালোবাসতেন। স্বয়ম্বর সভায়  শল্য উপস্থিতও ছিলেন কিন্তু ভীষ্মের কারণে সব ওলট পালট হয় গেল। অবশ্য তখন পর্যন্ত ভীষ্ম জানতেনই না যে অম্বা  শল্যকে ভালোবসেন। সেটা তিনি জানলেন রাজকন্যাদের হস্তিনাপুরে নিয়ে আসর পর। বাকি দুই রাজকন্যার বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করতে আপত্তি না করলেই অম্বা বেঁকে বসলেন। অম্বা বললেন তিনি যেহেতু শল্যের বাগদত্তা সেহেতু তিনি শল্য ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেন না। ভীষ্ম তাৎক্ষণিকভাবে অম্বাকে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অম্বাকে সৌভ্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু স্বয়ম্বরের পরপর ভীষ্মকে ঠেকাতে গিয়ে শল্য ভীষ্মের কাছে যে নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন, সেই অপমানের কথা ভীষ্ম ভুলে যাননি।  তিন অম্বাকে গ্রহণ করতে রাজী হলেন না।  তিনি অম্বাকে ফিরিয়ে দিলেন।  

রাজকুমারী অম্বার কাশীতে ফিরে যাবার উপায় ছিল না।  তিনি হস্তিনাপুরে ভীষ্মের কাছে ফিরে এলেন। ভীষ্মকে বললেন শল্য তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন, তাঁর পক্ষে কাশীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তার এই দুরাবস্থার জন্যে ভীষ্মই দায়ী । ভীষ্ম তাঁকে জোরপূর্বক তুলে না আনলে এই অবস্থার সৃষ্টি হত না। ভীষ্মের উচিত এখন তাঁকে বিয়ে করা। কিন্তু ভীষ্ম বিয়ে না করার ভীষণ শপথ নিয়ে বসে আছেন। তিনি রাজী হলেন না; তাঁর কাছে অম্বার জীবনের চাইতে শপথের মূল্য অনেক বেশী।  দুচারটা জীবন ধ্বংস হয়ে গেলেও তাঁর কর্তব্য থেকে তাঁকে বিচ্যুত করা যাবে না।

এই গোটা ব্যাপরটা ভীষণ রকমের স্বার্থপরতামূলক। এই মহাভারতেই এক ঋষির কথা বলা হয়েছে যিনি মিথ্যা না বলার অপরাধে নরকে গেছেন কারণ ওই মিথ্যাটা বললে একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষা পেত। একই যুক্তি ভীষ্মের ক্ষেত্রেই খাটে। অম্বাকে বিয়ে করলে তিনি সত্যচুত হতেন সেকথা ঠিক কিন্তু অম্বার জীবনটা বেঁচে যেত, যে জীবনটা তিনি নিজের হাতে নষ্ঠ করেছেন। যে গুরুর কাছ থেকে  তিনি অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছেন সেই গুরুর আদেশও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। গুরু পিতারই মত।  দেবব্রতের কাছে ভীষ্ম হয়ে ওঠাটা অনেক বড়। ভীষ্মের কারণে অম্বার জীবনটা অকলে ঝরে গেল। এটাও এক ধরণের হত্যাকাণ্ডই। ভীষ্ম এই হত্যাকাণ্ডের দায় কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না।    


গল্পের ফাঁকফোঁকর: সূর্যদেব নন, দুর্বাসাই কর্ণের পিতা। -
Guitar K Kanungo
Jan. 8, 2025 | category | views:82 | likes:5 | share: 3 | comments:0

কবি নবীনচন্দ্র সেন বলেছিলেন, কর্ণ আসলে দুর্বাসারই সন্তান। দুর্বাসার বর দেয়ার যে ব্যাপারটা বলা হয়, সেটা আসলে একটা গালগপ্প। কুন্তী রাজা কুন্তিভোজের ঔরসজাত কন্যা ছিলেন না; সেইজন্যেই হয়ত এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, জেনেও দুর্বাসার সেবায় কুমারী কুন্তীকে নিয়োগ করছিলেন।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, কর্ণ যদি দুর্বাসার পুত্র হয়, তাহলে মহাভারতের প্লটে একটা ভালো রকমের জট পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রথম জট, পরশুরাম কর্ণকে ক্ষত্রিয় অপবাদ দিয়ে তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান ফিরিয়ে নিতে পারেন না, কারণ দুর্বাসার পুত্র হলে কর্ণ কিন্তু আর ক্ষত্রিয় থাকছেন, তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে উঠছেন। অবশ্য তিনি ক্ষত্রিয়দের শিক্ষা দেন না, একথাটাও যে পরশুরাম ঠিক বলেছেন, তা কিন্তু নয়। তিনি হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর পুত্র দেবব্রতকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কর্ণের বেলায় তিনি কেন এর ব্যতিক্রম করলেন, সেটা পরশুরামই ভালো বলতে পারবেন।


আরো একটা ব্যাপার আছে। নারদের ব্যাখ্যা মতে, যে কীট কর্ণের উরুতে দংশন করেছিল, সে আসলে ছিল একজন অসুর। মহর্ষি ভৃগুর স্ত্রীকে অপরহরণ করার চেষ্টা করেছিল, বলে ভৃগু তাকে কীট হয়ে যাবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। যেটা সবসময় হয়, অপরাধ করার সময় কারোই মনে থাকে না যে এর ফলে অভিশাপ নেমে আসতে পারে, কিন্তু যখন সত্যি সত্যি অভিশাপ নেমে আসে, তখন সেই অভিশাপ খণ্ডন করার চেষ্টা করে। এই অসুরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। অসুরের কাকুতি মিনতিতে নরম হয়ে ভৃগু বলেছিলেন, উত্তরকালে, কোন এক সময় পরশুরামের সঙ্গে তার দেখা হবে, আর তখনই তার কীট দশা কেটে যাবে। এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছিল। পরশুরামের চোখের সামনেই, সেই কীট অসুরে পরিণত হয়ে আকাশপথে উড়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনা অবধারিতই ছিল; এখানে কর্ণের দোষটা কোথায়? পরশুরাম কর্ণকে অভিশাপ দিতে গেলেন কেন?

তিনি ইচ্ছে করলে, অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে, তিনি চাইলে ধ্যানযোগে কর্ণের সত্যিকারের পিতৃ-পরিচয় জেনে নিতে পারতেন। সেক্ষেত্রে যেটা হত, কর্ণ প্রয়োজনের সময়ে ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করতে পারতেন, যেটা তিনি পরশুরামের অভিশাপের কারণে করতে পারেননি। তাতে যেটা হয়েছে, অর্জুনের কাছে তাঁর পরাজয় মেনে না নিয়ে কোন উপায় ছিল না। এর আগে ইন্দ্রের দেয়া একাগ্নি বানটাও খরচ হয়ে গিয়েছিল, ঘটোৎকচকে বধ করতে গিয়ে। এরই মধ্যে সহজাত কবচ কুন্ডলাটাই হারিয়ে বসেছেন। গোটা মহাভারত জুড়ে অর্জুনকে বড় করে, এবং কর্ণকে খাটো করে দেখানোই আয়োজন।

এরকম আরেকটা অদ্ভুত ঘটনার ঘটতে দেখি, যখন মহারাজ পান্ডু মৃগয়া করতে গেলেন। কিন্দম নামের এক ঋষিকে তিনি হত্যা করেছিলেন। মহাভারতে, যদিও বলার চেষ্টা করা হয়েছে, তিনি ভুল করে মেরেছেন, কিন্তু কথাটা সত্য নয়। এই কিন্দম মুনি আসলে একটা মৃগীর সঙ্গে সঙ্গম করছিল, যেটা ভয়াবহ ধরনের অনাচার এবং রাজ্যের অভ্যন্তরে, কেউ যদি, এমনকি সেই কেউ যদি একজন ঋষিও হয়, রাজার কর্তব্য তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া। মহারাজ পান্ডু সেই কাজটাই করেছেন। কিন্দমের মত একজন বিকারগ্রস্থ ঋষির অভিশাপ কার্যকর হবার কথা ছিল না, এবং আমার ধারণা সেটা হয়নি।


পঞ্চপান্ডব পান্ডুরই সন্তান। এই দেবতাদের ওরসে জন্ম-টন্ম এইসবই গাঁজাখুরি ব্যাপারই। তাছাড়া, আমরা যদি মেনে নিই, কর্ণ দুর্বাসারই সন্তান, তাহলে তাঁর দেবতাদের ডেকে এনে গর্ভসঞ্চার করার ব্যাপারটা এমনিতেই মিথ্যে হয়ে যায়। মহাভারতেরই এক জায়গায় বলা আছে, মহারাজ পান্ডু সন্তান লাভের জন্য যজ্ঞ করছিলেন।


বিকৃত কামাচারী হলেও, কিন্দম একজন ব্রাহ্মণ; সেই যুগে ব্রাহ্মণ হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। রাবণকে হত্যা করার কারণে, রামকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল, কারণ রাবণ যাতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। অভিশাপ জনিত কারণে, পান্ডুর মধ্যে একটা ভয় হয়ত ছিল, কিন্তু তাঁর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল না, একথাটা ঠিক নয়। যদি তাই হত, তাহলে তিনি যজ্ঞ করতে যেতেন না। ঘটনারগুলোর মধ্যে বেশ কিছু অসংগতি আছে, একটার সঙ্গে আরেকটা ঠিক খাপ খেতে চায় না।


সমস্ত অলৌকিকতাকে যদি অস্বীকার করি, তাহলে বলতে হবে, পরশুরাম আদৌ কর্ণকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন কিনা, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। ত্রেতা যুগে পরশুরাম জন্মেছিলেন। সেই পরশুরাম, দ্বাপর যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন - এটাকে মেনে নেয়া যায় না। অনেকেই হয়ত বলবেন, তিনি তো চিরঞ্জীবী - সবযুগেই বেঁচে আছেন, এমনকি এখনো বেঁচে আছেন। সেক্ষেত্রে, এখন কেউ মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় গিয়ে হাজির হলে পরশুরামের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার কথা; কিন্তু নিশ্চিত জানি, এরকম কারো সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।


এক্ষেত্রে, পুরানবিদ নৃসিং প্রসাদ ভাদুড়ির কথাটা অনেক যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছেন, পরশুরাম, বশিষ্ঠ, ভরদ্বাজ -এঁরা আসলে এক ব্যক্তি নন। এরা একেকটা ঘরানার মত; যারাই এঁদের ধারাকে অনুসরণ করে, তারা সেই ঘরানার নামেই পরিচিত হয়। অর্থাৎ, দ্বাপর যুগে আমরা যে পরশুরামকে দেখছি, তিনি আসলে ত্রেতা যুগের পরশুরাম নন; তিনি পরশুরামের এক বিখ্যাত শিষ্য।

গল্পের ফাঁকফোঁকর : পিতার অন্যায্য সন্তুষ্টি বিধানও কি ধর্ম ? -
Guitar K Kanungo
Jan. 6, 2025 | category | views:50 | likes:5 | share: 2 | comments:0

আদি পুরুষ হলেও মনু মহারাজ আমার পছন্দের ব্যাক্তি নন। পুরানবিদদের মধ্যে এঁর  মত পাঁড় 'মিসোজিনিস্ট' আর একটিও নেই। কিন্তু আজকের আলোচনায় জন্যে মনুস্মৃতি থেকে একটা শ্লোক ধার করতেই হচ্ছে। শ্লোকটা এইরকম :

পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম: পিত্য হি পরমং তপ:
পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।
 
এই মন্ত্রের সরলার্থ - পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ট তপস্যা। পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। এককথায় পিতার সন্তুষ্টি বিধান করাই সন্তানের কর্তব্য। প্রশ্ন হচ্ছে সবসময় কি পিতাকে সন্তুষ্ঠ করা যায়? পিতা যদি অন্যায্য কথা বলে সেক্ষেত্রে পুত্রের কর্তব্য কি হবে?

পিতা-পুত্রের সম্পর্কের এই জটিলতা নিয়ে হিন্দু পুরাণে কয়েকটি  ঘটনার কথা বলা আছে। সেই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্ঠা করা যেতে পারে। 

প্রথম ঘটনাবাল্মিকী রামায়ণ থেকে উদ্ধৃত।

অযোধ্যার রাজা দশরথ নবোঢ়া পত্নীর প্রেমে বিগলিত হয়ে সেই পত্নীর তিনটি ইচ্ছে পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেই স্ত্রী একসময় রাজা দশরথের কাছে জ্যেষ্ঠপুত্র রামের পরিবর্তে তাঁর গর্ভজাত ভরতকে অযোধ্যার রাজা এবং রামকে একটা লম্বা সময়ের জন্যে বনবাসে পাঠানোর দাবী জানালেন। দশরথ নিরুপায় কারণ তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

কিন্তু রাম নিরুপায় ছিলেন না। তাঁর সামনে তখন দুটো উপায় খোলা ছিল: প্রথম উপায় পিতাকে সরিয়ে নিজেই অযোধ্যার রাজা হয়ে বসা; দ্বিতীয় উপায় পিতার আদেশ মেনে নিয়ে বনবাসে চলে যাওয়া। প্রথমটা তার অধিকার, দ্বিতীয়টা তাঁর কর্তব্য ; রাম কর্তব্যটাকেই বেছে নিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে রামের এই সিন্ধান্তকে মহৎ একটা কাজ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু পিতা দশরথ তাতে সন্তুষ্ঠ হয়েছিলেন কি? রাম দশরথের সত্য পালনে সহায়তা করলে পিতার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেননি। 

প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা সত্বেও দশরথ চাননি রাম বনবাসে যাক। রামের এই চলে যাওয়াটা তাঁকে  এতটাই আহত করেছিল যে রাম রাজধানী ত্যাগ করার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেহত্যাগ করেন।রাম কি অনুমান করতে পারেননি এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে? যদি অনুমান করতে পারেন তাহলে তাঁর এইভাবে বনবাসে যাবার তো কোন প্রয়োজন ছিল না। প্রতিশ্রুতি তো তিনি দেননি, সে দায় পিতা দশরথের। তাঁর দায় ছিল কেবল পিতার সন্তুষ্টি বিধান করা। তাহলে রাম কি ঠিক কাজটি করেননি ?

দ্বিতীয় ঘটনা -  মহাভারত থেকে উদ্ধৃত।

বাসুদেব কৃষ্ণের একজন পূর্বপুরুষ ছিলেন - যযাতি। যয়াতি রাজা হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শাসন করছিলেন। অসুরদের গুরু  শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী ছিলেন তাঁর স্ত্রী।  এই দেবযানীর সঙ্গে  অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠাও এসেছিলেন দেবযানীর সঙ্গে, যেহেতু তিনি দেবযানীর দাসী ছিলেন। যয়াতি  শর্মিষ্ঠার প্রতিও আকৃষ্ট হন এবং গোপনে তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। দেবযানী যখন ঘটনা জানতে পারেন, তখন রুষ্ট হয়ে তিনি তাঁর পিতা শুক্রাচার্যের কাছে অভিযোগ করেন। ক্রুদ্ধ শুক্রাচার্য যয়াতিকে বার্ধক্যের অভিশাপ দেন; যয়াতি প্রোঢ়ত্বে পৌঁছনোর আগেই বার্ধক্যে পৌঁছে যান। এদিকে যযাতি ছিলেন অত্যন্ত কামুক একজন পুরুষ; তিনি কামপ্রবৃত্তি পূরণের জন্যে আবারো তাঁর যৌবন ফিরে পেতে চাইছিলেন। শুক্রাচার্যের অভিশাপের শর্ত অনুযায়ী যযাতির অন্য কারো সঙ্গে তাঁর জরা বদলের সুযোগ ছিল। ফলত তিনি তাঁর পাঁচ পুত্রের মধ্যে একজনকে তাঁর বার্ধক্য গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন, যাতে তিনি পুনরায় যৌবনের সুখ উপভোগ করতে পারেন। যয়াতির প্রথম চারপূত্র তাঁর এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেও, তাঁর পঞ্চম পুত্র পুরু পিতার বার্ধক্য গ্রহণ করতে সম্মত হয়।

অনেক প্রজন্ম পরে দেবব্রত পিতা শান্তনুর যৌন লালসা পূরণের সুযোগ করে দেবার জন্যে নিজে সারাজীবন কৌমার্য ব্রত পালন করার শপথ গ্রহণ করবেন  অর্থাৎ তিনি পিতার সন্তুষ্টি বিধান করাটাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করবেন যে সন্তুষ্টি বিধান করতে গিয়ে পুরু পিতার বার্ধক্যকে গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি। 

কিন্তু সন্তুষ্টি বিধানটাই কি সবকথা? পুত্র কিংবা কন্যার একমাত্র ধর্ম, বিশেষ করে পিতা যদি ক্ষমতাবান হন? যে পুত্ররা বার্ধক্য গ্রহণ করতে রাজী হয়নি, যযাতি সেই পুত্রদের প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন যে কাজটা তাঁর দিক থেকে অনৈতিক হয়েছে। এইরকম একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপীয়ার একটি নাটক রচনা করেছিলেন। এই নাটকে ব্রিটেনের রাজা লেয়ার তাঁর তিনি মেয়েকে একদিন কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন তারা তাঁকে কেমন ভালোবাসে। বড় এবং মেজ মেয়ে ছিল ভীষণ চালাক। তারা জানত তাদের বাবা উত্তর শুনে সন্তুষ্ঠ না হলে আখেরে তাদের ক্ষতিই হবে; রাজ্যের অংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবার সমূহ সম্ভাবনা। অতএব তার এমন উত্তর একটা উত্তর দিল যে উত্তর শুনে লিয়ার বেজায় খুশী হলেন। লিয়ারের তৃতীয় এবং কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল কর্ডেলিয়া। একই প্রশ্ন তাকে করা হলে সে কোন রকমের ভণিতার আশ্রয় না নিয়ে বলেছিলে একজন সন্তানের তার পিতাকে যতোটুকু ভালোবাসা উচিত তিনি রাজা লিয়ারকে ততটাই ভালোবাসেন। রাজা লিয়ার উত্তরটা শুনে প্রচন্ড  বিরক্ত হলেন; তিনি কর্ডেলিয়াকে সমস্ত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে গোটা রাজ্য বড় দুই মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। বড় দুই মেয়ের মিথ্যাভাষণে বিভ্রান্ত হয়ে রাজা লিয়ার যে কত বড় ভুল সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে। সন্তুষ্ঠ করার এবং সন্তুষ্ট হবার মধ্যে বড় ধরনের একটা প্রভেদ আছে। ব্যাপারটা উপরের দিক থেকে যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ নয়।  

তৃতীয় ঘটনা : মহাভারত থেকে উদ্ধৃত।

রেণুকা ছিলেন ঋষি জমদগ্নির স্ত্রী।  খুবই পতিব্রতা একজন নারী ছিলেন তিনি।  এতটাই যে জমদগ্নি যখন তীরচালনা প্রাকটিস করতেন তখন রেণুকা দৌড়ে গিয়ে সেই তীর কুড়িয়ে আনতেন। এহেন রেণুকা জলকে গিয়ে একদিন এক গন্ধর্ব এবং তাঁর স্ত্রীদের জলকেলী দেখে কিছুটা মোহিত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে এরকম ভাবের উদয় কেন হল এই অপরাধে জমদগ্নি তাঁর ছেলেদের রেণুকার ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে ফেলতে। রেণুকা এবং জমদগ্নির বাসু এবং বিশ্বাবাসু নামের দুজন এবং পরশুরাম নামের আরো একজন সন্তান ছিল। পিতা অসন্তুষ্ট হবে জেনেও প্রথম দুই সন্তান গর্ভধারিণীকে হত্যা করতে রাজী হল না। পিতার আদেশ পালন করতে গিয়ে মা'কে হত্যা! বড় রকমের ধর্মসঙ্কট।

 কিন্তু পরশুরাম তাৎক্ষণিকভাবে কোন প্রশ্ন না  করেই একটা কুঠার দিয়ে জননী রেণুকার মাথা কেটে ফেলেন। শুধু তাই নয়, রেণুকা আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আশ্রমের আশেপাশে বসবাস করে এমনকিছু অন্ত্যজ মানুষদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর এই ঋষিপুত্র এই অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর বাড়িতে পা দেবেন না কিন্তু পরশুরাম সেখানে তো গেলেনেই, উম্মাদনার এক পর্যায়ে মায়ের মাথা কাটতে গিয়ে ওই অন্ত্যজ পরিবারের এক নারীরও মাথা কেটে ফেলেছিলেন।যেটা নিয়ে পরবর্তীতে আরেকটা বিপত্তি তৈরি হবে। তবে সেই আলোচনা এখানে মুখ্য নয়।  

যদিও রেণুকা পরবর্তীতে প্রাণ ফিরে পাবেন কিন্তু পরশুরাম কি কাজটা ঠিক করেছেন? এই প্রশ্নটা সবসময়ই উঠেছে এবং এখনো প্রাসঙ্গিক। জমদগ্নি দুটো অসংলগ্ন কাজ করেছেন। প্রথমত তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার গোলযোগের মধ্যে জড়িয়েছেন যে কাজটা তাঁর একেবারেই উচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত জমদগ্নি নিজে একজন ঋষি হলেও রেণুকা একজন সাধারণ, তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় জয় করে বসে থাকেননি।  তাছাড়া তিনি একজন ক্ষত্রিয়াণীও বটে। জমদগ্নির সঙ্গে বিয়ের আগে তিনি একজন  রাজকন্যা ছিলেন। গান্ধর্বের জলকেলী ক্ষত্রিযসুলভ আচরণ ; সেটা দেখে তিনি  কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে উঠতেই পারেন। এটা বড় কোন অপরাধ হতে পারে না।  এটা অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা যেত যদি রেণুকা দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার মত চন্দ্রদেবর সঙ্গে পালিয়ে যেতেন এবং চন্দ্রের সন্তান গর্ভে ধারণ করে ফিরে আসতেন। জমদগ্নি লঘু পাপে গুরুদন্ডের বিধান দিয়েছেন।  

লক্ষ্য করবার বিষয় ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসাবে খ্যাত পরশুরাম পিতার আদেশে মাটিকে হত্যা করার প্রশ্নে কোন রকমের ধর্মসঙ্কট অনুভব করেননি। তিনি স্পষ্টতই মায়ের মৃত্যুর চাইতে পিতার আদেশকে অনেক বড় করে দেখেছেন। তাঁর পিতার হত্যাকারী ক্ষত্রিয় রাজাটিকে তিনি খুন করেছিলেন এবং সেখানেই তাঁর হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটার কথা ছিল কিন্তু তিনি সেখানে থামেননি, তিনি আরো একুশবার এইরকম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন , যেটা করার কোন ন্যায়সঙ্গত অধিকার তাঁর ছিল না। এই জন্যে হিন্দু পুরাণে পরশুরামকে একজন অবতারের মর্যাদা দেয়া হলেও কেউ যদি তাঁকে একজন একজন বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী এবং সাইকোপ্যাথিক কিলার বলে মনে করে, তাহলে কি তাকে খুব একটা দোষ দেয়া চলে?

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগমুহূর্তে অর্জুন এইরকমই একটা ধর্মসংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন। অর্জুনকেও অস্ত্র ধারণ করতে হচ্ছিল তার ভাইদের বিরুদ্ধে। কৃষ্ণ তাঁকে অস্ত্রধারণ করার উপদেশ দিয়েছিলেন। অর্জুনকে যদি এইরকম একটা অবস্থার মুখোমুখি, অর্থাৎ কুন্তীকে হত্যা করার কথা বলা হত কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত গোপন করার অপরাধে, তাহলে  বাসুদেব কৃষ্ণ তাকে কী উপদেশ দিতেন?

বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনকে বারবার বলেছেন ধর্ম মানে অন্ধভাবে কোনো নিয়ম মেনে চলা নয়, বরং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। যদি অর্জুনকে মাতা কুন্তীকে  হত্যা করতে বলা হত, এবং যেহেতু এই আদেশ নৈতিকতার পরিপন্থী ছিল, কৃষ্ণ সম্ভবত অর্জুনকে এই আদেশ অন্ধভাবে অনুসরণ না করে এই আদেশ নিয়ে প্রশ্ন করতে এবং এই আদেশের ন্যায়সঙ্গতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পরামর্শ দিতেন। কৃষ্ণ বলেছেন অহিংসা ত্যাগ করে যুদ্ধ কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য যখন তা ধর্ম রক্ষার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সেটা অপরিহার্য ছিল না। নিজ মাতাকে হত্যা করার মতো আদেশ নিশ্চিতভাবে অহিংসার বিরোধী, এবং কৃষ্ণ অর্জুনকে সম্ভবত সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার কথাই বলতেন। তাছাড়া কৃষ্ণ এটাও বলেছেন প্রতিটি কাজের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি থাকে। মা'কে হত্যা করার মতো একটি চরম কাজের কেবল তাৎক্ষণিক নয়, ভবিষ্যত পরিণতিও যে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই অর্জুনকে সেকথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

 

গল্পের ফাঁকফোঁকর : সদা সত্য কথা বলা ভালো নয়। -
Guitar K Kanungo
Jan. 3, 2025 | category | views:91 | likes:2 | share: 2 | comments:0

এক পথিক দস্যুদের ভয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক ঋষির কুঠিরে আশ্রয় নেয়।  কিছুক্ষণ পরেই দস্যুরা সেই আশ্রমে এসে উপিস্থত হয়। তার ঋষিকে একটা লোক কিছুক্ষন আগে তাঁর কুঠিরে আশ্রয় নিয়েছে কিনা। ঋষি ভেবে দেখলেন সত্য কথা বললে লোকটার প্রাণ যাবে। আবার মিথ্যে কথা বললে তার পাপ হবে। তিনি নিরুত্তর থাকাটায় শ্রেয় বিবেচনা করলেন। দস্যুরা হৃষীকে নিরুত্তর দেখে নিজেরাই কুঠিরের ভেতর লুকিয়ে থাকা পথিককে খুঁজে বের করল। তারপর তার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে তার মৃতদেহ সেখানে ফেলে রেখে চলে গেল।

প্রকৃতির নিয়ম মেনে একদিন সেই ঋষির মৃত্যু হল। কিন্তু যমরাজ তাকে নরকভোগের জন্য পাঠিয়ে দিলেন সেদিনের তার স্বার্থপর আচরণের জন্যে, তিনি নিজের পাপকে একজন মানুষের জীবনের চাইতেও বড় করে দেখেছেন। এই গল্পটা ছোটবেলায় অনেকেই শুনেছেন। এই গল্পের মর্মার্থটা তাই খোলাসা করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। পুরাণে আরেকটা গল্প আছে যেটা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। সেই গল্পটা বলি।  

দেবতাদের গুরু মহর্ষি বৃহস্পতি। তাঁর স্ত্রীর নাম তারা যিনি কিনা পঞ্চকন্যাদের একজন। তিনি সুন্দরী ছিলেন, স্বাস্থ্যবতী ছিলেন। এদিকে চন্দ্রদেব দেবতাদের মধ্যে অন্যতম  আকর্ষনীয় দেবতা ছিলেন। গুরুপত্নী তারা এই চন্দ্রদেবের প্রেমে পড়ে গেলেন। খুবই গর্হিত কাজ! কিন্তু প্রেম কবে কোথায় নিয়ম মেনে চলেছে? সম্পর্ক যেহেতু অবৈধ তারা চন্দ্রকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন।

আগেই বলেছি বৃহস্পতি দেবতাদের গুরু। চন্দ্রদেবের এই অনৈতিক আচরণে দেবরাজ ইন্দ্র বিশেষ ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি চন্দ্রদেবেকে অবিলম্বে তারাকে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। চন্দ্রদেব ইন্দ্রের আদেশ থোড়াই কেয়ার করলেন। তিনি তখন তারার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত। ফলত ইন্দ্রকে চন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হল।  অনেকটা হেলেনকে উদ্ধার করার জন্য মেনেলাউসকে ট্রোজান রাজকুমার প্যারিসের বিরুদ্ধে যেরকম যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিল সেরকম। সেই যুদ্ধে চন্দ্র পরাজিত হলেন এবং তারাকে বৃহস্পতির কাছে ফিরিয়ে দেয়া হল।

বৃহস্পতি অবশ্য কোন রকম প্রশ্ন ছাড়াই তারাকে গ্রহণ করলেন।  রামায়ণে আমরা দেখেছি রামচন্দ্র সীতাকে অনায়াসে গ্রহণ করেননি। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল এবং রাম এরকম কথাও বলেছিলেন তিনি সীতাকে উদ্ধার করার জন্যে লংকায় এসে রাবনকে বধ করেননি। বৃহস্পতি অনেকটা ইলিয়াড মহাকাব্যের মেনেলাউসের মতোই আচরণ করবেন। হেলেন নিজ থেকে প্যারিসের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই পালিয়ে যাবার কারণে মেনেলাউস ব্যাক্তিগতভাবে যথেষ্ট পরিমানে অসম্মানিত হয়েছিলেন। পুরুষ হিসাবে তার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেইজন্যে হেলেনের প্রতি তার এক রাশ ঘৃণা এবং আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল, কিন্তু ট্রয় নগরী ধ্বংস হবার পর মেনেলাউস হেলেনকে দেখে সব ঘৃণা সব আক্রোশ এক নিমিষে ভুলে গিয়েছিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতির ক্ষেত্রে এরকমই একটা কিছু হয়েছিল। তিনি কোন প্রশ্ন ছাড়াই স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিলেন।


স্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতা করলেও স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু সমস্যা একটা থেকেই গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তারা যতদিনে বৃহস্পতির কাছে ফিরে এসেছেন ততদিনে তিনি গর্ভবতী। অনাগত এই সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বৃহস্পতি বললেন আমার সন্তান। চন্দ্র বললেন আমার সন্তান। এদিকে তারা কিন্তু কিছুই বললেন না অথচ সন্তানের আসল পিতা কে, সেটা একমাত্র তারারই জানার কথা।

এরকম একটা অদ্ভুতুড়ে অবস্থায় তারার গর্ভস্থ সন্তানই বলে উঠল - আমি স্বামীর নই, প্রেমিকের সন্তান। সেই সন্তানের নাম দেয়া হবে বুধ।  বুধের সততা এবং এই বিশেষ ক্ষমতায় দেবতার বেশ চমৎকৃত হলেন। দেবতারা চমৎকৃত হলেও বৃহস্পতি নিজের ক্রোধ দমন করতে পারলেন না। তিনি অভিশাপ দিলেন - তারার গর্ভস্থ এই সন্তান লিঙ্গহীন হয়েই জন্মাবে- অর্থাৎ সে নারী ও হবে না, আবার পুরুষও হবে না। তাই হয়েছিল। এইজন্যে বুধকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে যেরকম আমাদের সমাজে অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পোহাতে হয়। নিজের পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে সত্য কথা বলেই বুধ নিজের জন্যে এই বিপদটা ডেকে এনেছিল। সে চুপচাপ থাকলেই পারত। চাপের মুখে তারাই একসময় ক্র্যাক করত।  

এখানে আরেকটা গুরুতর বিষয় আছে। হেলেন এবং তারা কিছুটা তুলনীয় হলেও, বৃহস্পতি এবং মেনেলাউস একে অপরের সঙ্গে তুলনীয় নন। মেনেলাউস একজন রাজা ছিলেন—তাঁর চরিত্রে কিছু সহজাত ত্রুটি থাকতেই পারে, কিন্তু বৃহস্পতি একজন ঋষি। তিনি অন্য কোনো নারীর প্রতি আসক্ত ছিলেন, এমন কোনো খবর আমরা পুরাণে খুঁজে পাই না। আবার তিনি স্ত্রী তারাকে অনাদর করেছেন, সেরকম কোনো খবরও পুরাণ আমাদের দেয় না। তাহলে তারা চন্দ্রদেবের প্রতি আকৃষ্ট হলেন কেন?

গোটা ব্যাপারটা কি কেবলই যৌনতা? যদি তাই হবে, তাহলে বৃহস্পতি অনুসূয়া নন। অনুসূয়া স্বামীর প্রতি তাঁর অচলা ভক্তি এবং ভালোবাসার জন্য একজন সতী নারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি অনুসূয়া না হন, তাহলে তাঁকে পঞ্চকন্যাদের একজন হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হলো কেন? কেন একজন সাধারণ হিন্দু নারীকে এমন একজন নারীর কথা স্মরণ করতে হবে, যিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলেন?
গল্পের ফাঁকফোঁকর: ছেলেমেয়েরা মা'কেই বেশি ভালোবাসে। -
Guitar K Kanungo
Jan. 2, 2025 | category | views:57 | likes:2 | share: 2 | comments:0

অনেক অনেক বছর আগে ভাঙ্গাশ্বন নামের একজন রাজা ছিলেন।

আমি বুঝতে পারি না, আগেকার রাজাদের মধ্যে একশত সন্তান জন্ম দেবার কেন এতটা আকুতি। ভীষ্ম গান্ধার রাজ্যের রাজকন্যা গান্ধারীকে তুলে আনতে গিয়েছিলেন, কারণ গান্ধারীর একশ সন্তান জন্ম দেবেন কিংবা দিতে পারবেন—এরকম একটা কথা বাজারে প্রচলিত ছিল। কুন্তীর ক্ষেত্রেও একশ সন্তান না হলেও একাধিক সন্তান যে তিনি জন্ম দিতে পারবেন, সেই সব সন্তান দেবতার ঔরসে জন্মাবে—এরকম একটা কথা প্রচলিত ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সেটাই ঘটেছিল।

যাই হোক, মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন একশ সন্তান লাভের আশায় খুব ধুমধামের সঙ্গে একটি যজ্ঞ করলেন। যজ্ঞে দেবতারা বেশ সন্তুষ্ট হলেন। ফলত অচিরেই তিনি একশ সন্তানের পিতা হলেন। তাঁর স্ত্রী একশ সন্তানের জন্ম দিলেন। যজ্ঞ করার সময় মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন একটা গুরুতর ভুল করে ফেলেছিলেন। তিনি দেবরাজ ইন্দ্রকে আহুতি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁর যজ্ঞের যারা পুরোহিত ছিলেন তারাও ভুলে গিয়েছিলেন মহারাজকে এই ব্যাপারটা স্মরণ করিয়ে দিতে।

ফলত, ইন্দ্র ভীষণ কুপিত হলেন। তিনি ভাঙ্গাশ্বনকে নারীতে রূপান্তরিত করলেন। এই নারীতে রূপান্তরিত হওয়া 'রানী' ভাঙ্গাশ্বনও একসময় একশ সন্তানের জন্ম দিলেন। এর ফলে একটা ইউনিক অবস্থার সৃষ্টি হল। রাণীর গর্ভে জন্ম নেওয়া একশ সন্তান তাঁকে বাবা বলে সম্বোধন করছে, আবার তাঁর নিজের গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানেরা তাঁকে মা বলে সম্বোধন করছে।

ভাঙ্গাশ্বন দুইশ সন্তান নিয়ে ভালোই ছিলেন, কিন্তু ইন্দ্রের সেটা সহ্য হল না। তিনি চেয়েছিলেন ভাঙ্গাশ্বন অশান্তিতে থাকুক। এই অবস্থায় ইন্দ্র আরো কুপিত হলেন। এবার তিনি দ্বিতীয় অভিশাপটি উচ্চারণ করলেন—এই দুইশ সন্তান নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এই অভিশাপের কথা জানতে পেরে ভাঙ্গাশ্বন খুবই মর্মাহত হলেন। তিনি রাজপুরোহিতদের ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, দেবরাজ ইন্দ্র কেন তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন।

কারণ জানতে পেরে তিনি আবারো যজ্ঞের আয়োজন করলেন এবং এবার যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক দেবরাজ ইন্দ্রকে আহুতি দিলেন। ইন্দ্র সন্তুষ্ট হলেন, এদিকে দুইশ সন্তানের সবাই ততদিনে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, মারামারি করে মারা গেছে। মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন ইন্দ্রের কাছে আবেদন জানালেন তাঁর সন্তানদের বাঁচিয়ে দিতে।

ইন্দ্র সম্মত হলেন, কারণ তিনি ইতোমধ্যে যজ্ঞের আহুতিতে সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু তিনি একটা শর্ত দিলেন। ইন্দ্র বললেন—"মহারাজ, আমি আপনার একশ জন সন্তানকে বাঁচিয়ে তুলব। আপনিই বলুন, আমি কাদের বাঁচিয়ে তুলব? যারা আপনাকে পিতা বলে সম্বোধন করে, তাদের বাঁচিয়ে তুলব, নাকি যারা আপনাকে মা বলে সম্বোধন করে, তাদের?"

মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন কালবিলম্ব না করেই উত্তর দিলেন—"প্রভু, আপনি যে সন্তানরা আমাকে মা বলে ডাকে, তাদেরকেই বাঁচিয়ে তুলুন। ছেলে-মেয়েরা তাদের মা'কেই বাবার চাইতে বেশি ভালোবাসে।"

দেবরাজ ইন্দ্র বললেন—"তবে তাই হোক।"

কিন্তু ইন্দ্রের অভিশাপের আরো একটা অংশ তখনো কার্যকর রয়ে গেছিল। মহারাজ ভাঙ্গাশ্বনকে নারীতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, তিনি তখনো তাই ছিলেন। এবার দেবরাজ ইন্দ্র জানতে চাইলেন ভাঙ্গাশ্বন লিঙ্গ পরিবর্তন করে আবারো পুরুষ হয়ে উঠতে চান কিনা। দেবরাজ ইন্দ্রকে অবাক করে দিয়ে ভাঙ্গাশ্বন নারীই থেকে যেতে চান। নারী হিসাবেই তিনি যৌনতাকে অনেক বেশি উপভোগ করেছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, মহারাজ ভাঙ্গাশ্বন পুরুষের তুলনায় নারী হিসাবেই যৌনতাকে বেশি মাত্রায় উপভোগ করলেন কিভাবে? তাঁর স্ত্রী তো পুরুষ হয়ে যাননি; তিনি তো নারীই ছিলেন। তাহলে কি তিনি অন্য পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হতেন? মহারাজ ভাঙ্গাশ্বনের কি তাহলে কোন হারেম ছিল, যেখানে কামকলায় নিপুণ কিছু পুরুষের সমারোহ ছিল? রাজ্য শাসনটাই বা তিনি করছিলেন কোন পরিচয়ে? রাজা হিসাবে না রানী হিসাবে? মহাভারতে মহামতি ভীষ্ম এই গল্পটি বলেছিলেন। তাঁকে এই প্রশ্নগুলো কেউ করেনি, এবং তিনিও এসব প্রশ্নের কোন উত্তর দেননি।

গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে এরকম একটি গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়, কিছুটা ভিন্নভাবে। টাইরেসিয়াস নামের এক ব্যক্তি ঘটনাক্রমে একজোড়া সঙ্গমকারী সাপের স্ত্রী সাপটিকে হত্যা করে এবং অভিশপ্ত হয়ে নিজে একজন মহিলাতে পরিণত হন। বহু বছর পরে, একজন মহিলা হিসাবে জীবনযাপন করে, সে একজোড়া সঙ্গমকারী সাপের পুরুষ সঙ্গীটাকে হত্যা করে। এবার সে একজন পুরুষে পরিণত হয়। অর্থাৎ টাইরেসিয়াস এমন একজন ব্যক্তি, যে কিনা নারী এবং পুরুষ দুইভাবেই জীবনযাপন করেছে।

এদিকে যৌন ক্রিয়ায় কে বেশি আনন্দ পায়—এই নিয়ে অলিম্পিয়ান দেবতাদের রাজা জিউস এবং রাণী হেরার মধ্যে একটি তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। জিউস এই বিতর্কের সমাধানের জন্য টাইরেসিয়াসকে সাক্ষী মানলেন। টাইরেসিয়াসকে জিজ্ঞাসা করা হল, যৌন ক্রিয়ায় কে বেশি আনন্দ পায়, পুরুষ না মহিলা? টাইরেসিয়াস উত্তর দিল—"মহিলা।" উত্তর শুনে জিউস হাসলেন, কিন্তু হেরা খুবই বিব্রত এবং ক্রুদ্ধ হলেন। তিনি টাইরেসিয়াসকে অন্ধ হওয়ার জন্য অভিশাপ দেন।

যে গল্প আমাদের কখনো বলা হয় না। -
Guitar K Kanungo
Jan. 1, 2025 | category | views:43 | likes:3 | share: 2 | comments:0

মামা-ভাগ্নে একসঙ্গে হলেই যে সবকিছু ঠিকঠাক চলবে, এমন ভাবার কিছু নেই। নর্সদের প্রধান দেবতা ওডিনও কারো ভাগ্নে ছিলেন, অর্থাৎ তারও একজন মাতুল ছিল। সেই মাতুলের নাম মিমির। এই মিমির আবার সম্পর্কে ওডিনের মাতুল হলেও তিনি দেবতাদের শত্রুপক্ষই ছিলেন। মিমিরের একটা কুয়ো ছিল, টলটলে, শীতল জলে পুরিপুর্ণ, বিশেষ রকমের এক কুয়ো। এই কুয়ো থেকে কেউ এক ছিলিম জল পান করলে সে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হয়ে যেত। অনেকটা অমৃতের মত, যেটা পান করে হিন্দুদের দেবতাকূল অমর হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী? মিমির কাউকেই এই কুয়ো থেকে বিন্দু জল তুলতে দিত না।

ওডিন সেটা জানত। ওডিন এটাও জানত, তিনি দেবতাদের মধ্যে প্রধান হলেও তিনি অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী নন; তাঁর জ্ঞানও সীমাবদ্ধ। সেইজন্যেই তাঁর একদিন ইচ্ছে হল তিনি মিমিরের কুয়ো থেকে খানিকটা জল পান করে দেখবেন। সেই মোতাবেক মিমির যে এলাকায় বসবাস করতেন, সেই এলাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সেখানে যাওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না, এমনকি ওডিনের জন্যেও, তবুও ওডিন হাল ছাড়লেন না। তিনি সেখানে হাজির হলেন।

ওডিন ছদ্ববেশেই এসেছিলেন। কিন্তু বোনের এই মহাপ্রতাশালী ছেলেটিকে মিমিরের চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না। ভাগ্নেকে দেখে একটু হাসলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। ওডিন জানতেন, মিমির কথা বলার চাইতে কথা না বলতেই বেশী পছন্দ করে।

"মামা! আপনার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে চাই," ওডিন কোন ভনিতা না করেই বললেন।

মিমির দুপাশে মাথা নাড়লেন।

"কিন্তু আমি তো আপনার ভাগ্নে, তাই না? এটুকু আবদার আমি তো আপনার কাছে করতে পারি?"

"এই কুয়ো থেকে জল একমাত্র আমিই খেতে পারি, আর কেউ নয়," মিমির দৃঢ়কণ্ঠে বললেন।

ওডিন চাইলে জোর খাটাতে পারতেন। হাজার হোক তিনি দেবতাদের রাজা। তাঁর সেই ক্ষমতা ছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে সেই চিন্তা ওডিন বাতিল করে দিলেন। জ্ঞান গায়ের জোরে অর্জন করাবার জিনিস নয়। সত্যিকারের জ্ঞান বিনম্রতা এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই অর্জন করতে হয়।

হিন্দু পুরাণের একটা ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। অস্বথমা, আচার্য দ্রোণের পুত্র, এবং তিনি জানতেন তাঁর এই পুত্র অস্বথমা ব্রহ্মাস্ত্র ধরণের, অর্থাৎ এই অস্ত্রের জ্ঞান লাভের যোগ্য নন। সেইজন্যেই পুত্র হলেও তিনি এই জ্ঞান অস্বথমা কে দিতে চাইছিলেন না, কিন্তু অস্বথমা দ্রোণের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেন, তিনি পুত্রের চাইতে তাঁর একজন শিষ্যকে বেশি পছন্দ করেন। সেইজন্যে ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান তাকে না দিয়ে, সেই শিষ্যকে দিয়েছেন। স্নেহবৎসল পিতা শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মাস্ত্রের জ্ঞান দিলেন পুত্র অস্বথমাকে। যোগ্যতার জোরে অর্জিত হয়নি যে জ্ঞান, অবধারিতভাবে সেই জ্ঞানের অপপ্রয়োগ হয়েছে, এবং অস্বথমা সেই কারণে ভয়ঙ্কর অভিশাপ কুড়িয়েছেন।

মহাভারতে ব্যাস কী বলেছেন ওডিনের সেট জানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু জোর জবরদস্তি করতে চাইলেন না। মিমিরকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, "দেখুন মামা! আমি এতটা পথ আপনার কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে এসেছি। এর জন্য আমাকে যদি কোন মূল্য পরিশোধ করতে হয়, আমি সেই মূল্য দিতে রাজী।"

"তোমার একটা চোখ আমাকে দিয়ে দিতে হবে। যদি তুমি তাতে রাজী থাক, আমিও তোমাকে এই কুয়ো থেকে এক চুমুক জল খেতে দিতে রাজি আছি," মিমির নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন।

মিমির সত্যিই তাঁর চোখ চাইছে না, ভাগ্নে বলে তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করছে -  এই ভাবনাটাও ওডিন মাথায় আসতে দিলেন না। মিমিরের পৃথিবীতে আসতে গিয়েই ওডিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। জায়ান্টদের সঙ্গে দেবতাদের অনেক পুরোনো দিনের শত্রুতা। ভয়ঙ্কর শত্রুতা, বিশেষ করে ওডিন যাদের নেতৃত্ব দেন। সেই তুলনায় একটা চোখ তো কিছুই না। কুয়োর পারে একটা শামুকের খোল পড়ে ছিল। ওডিন সেই খোল দিয়ে তাঁর ডান চোখটা খুবলে বের করে মিমিরের হাতে তুলে দিলেন।

মিমির ওডিনের সেই চোখকে কুয়োর জলে ভাসিয়ে দিলেন। তারপর বিশেষ এক শিঙ্গায় ভরে, ওডিনকে কুয়োর জল খেতে দিলেন। কুয়োর জল ঠান্ডা। ওডিন এক চুমুকে পুরো জলটা পান করলেন। তাঁর শরীরে জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় প্লাবিত হয়ে গেল। তাঁর মনে হল তিনি আগে এক চোখে যা দেখতে পেতেন তার চাইতে অনেক বেশী দেখতে পাচ্ছেন। ওডিন শারীরিকভাবে একটি চোখ হারালেও তিনি আরো বেশী চক্ষুষ্মান বা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন  হয়ে উঠলেন।

মহাভারত অনুসারে হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ হলেও তাঁকে চক্ষুষ্মান বলা হত কারণ তার অন্তর্দৃষ্টি বা মানসিক জ্ঞান দৃষ্টিমানদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তিনি অন্ধ ছিলেন জন্মগতভাবে। দৃষ্টিহীনতার কারণে তিনি শারীরিকভাবে কিছু দেখতে না পারলেও তার মনের দৃষ্টি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তিনি এমন কিছু দেখতে পেতেন যা অন্যরা দেখতে পেত না।

নর্স পুরাণ অনুসারে মিমিরের কুয়োর জল পান করার মাধ্যমে ওডিন বিশ্বসংসারের গভীর সত্য রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। দেবতাদের রাজা এবং মানুষের স্রষ্টা হিসাবে সফল হবার জন্যে তাঁর এই বাড়তি জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। ফলে, দৃষ্টির বাইরের যে জ্ঞান, যেমন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান, প্রকৃতির গভীর তাৎপর্য ইত্যাদিএসবের প্রতি তার উপলব্ধি বৃদ্ধি পায়। ওডিনের এই ত্যাগকে জ্ঞানের জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, যেখানে শারীরিক ক্ষতি সত্ত্বেও তার মানসিক আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল

যে গল্প আমরা কখনোই বলি না। -
Guitar K Kanungo
Dec. 30, 2024 | category | views:113 | likes:4 | share: 2 | comments:0

ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম: ইসলামের নবী মুহাম্মদ যে পথ দিয়ে চলাফেরা করতেন, এক দুষ্টু বুড়ি সেই পথে অসংখ্য কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন। বোঝাই যাচ্ছে, সেই বুড়ি মুহাম্মদকে পছন্দ করতেন না। তবে কেন তিনি মুহাম্মদকে পছন্দ করতেন না, সেই কারণটা অবশ্য খোলাসা করে বলা হয়নি। যাই হোক, মুহাম্মদ কাঁটা সরিয়েই সে পথ দিয়ে অতি সাবধানে চলাফেরা করতেন।

একদিন মুহাম্মদ পথ চলতে গিয়ে দেখতে পেলেন, সে পথে কোনো কাঁটা বিছানো নেই। তিনি বেশ অবাক হলেন। পরের দিনও একই ঘটনা ঘটল। এইভাবে কয়েক দিন পরপর একই ঘটনা ঘটার পর মুহাম্মদ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবলেন, "বুড়ি মরেটরে গেল না তো!" তিনি খোঁজ নিয়ে বুড়ির বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। বুড়ি সত্যিই অসুস্থশয্যাশায়ী। কিন্তু বুড়ি মুহাম্মদকে তাঁর বাড়িতে দেখে খুবই অবাক হলেন। যার ক্ষতি করার জন্য তিনি এত ব্যস্ত ছিলেন, সেই মুহাম্মদ আজ তাঁর বাড়িতে এসে তাঁকে দেখতে এসেছেন ! সেইদিন থেকে বুড়ি মুহাম্মদের প্রতি তাঁর যে হিংসা ছিল, তা পরিত্যাগ করলেন।

এই গল্পে যে বুড়ির কথা বলা হয়েছে, তাঁর নির্দিষ্ট কোনো নাম বলা হয়নি। আগেই বলেছি, এটি ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদের জীবন থেকে নেওয়া একটি জনপ্রিয় ঘটনা। মুহাম্মদ যে কতটা সহনশীল এবং ক্ষমাশীল ছিলেন, সেটা তুলে ধরার জন্যই সাধারণত এই গল্পটি বলা হয়। কিন্তু যেহেতু বুড়ির নামের কোনো উল্লেখ নেই, সেহেতু এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা, নাকি পুরো ব্যাপারটা কারও কল্পনাপ্রসূত, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের ঘিরে নানা ধরনের কল্পকাহিনী গড়ে ওঠার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ধর্মপ্রচারকদের ক্ষেত্রে সেই মাত্রা আরো অনেক বেশি, যেহেতু এখানে অলৌকিকতার সংমিশ্রণের সুযোগও থাকে।

তবে ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা আছে, যেখানে মুহাম্মদকে খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, এবং যিনি এই কাজটি করেছিলেন, তাঁর নামও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর নাম জয়নাব বিনতে আল হারিথ। আমাদের অনেকেরই হয়তো এই নামটির সঙ্গে পরিচিত নই। খাইবার যুদ্ধের পরপরই এই ইহুদি রমণী মুহাম্মদকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ঘটনাটি বেশ কৌতূহল উদ্দীপক, কারণ সেই সময় মুহাম্মদ একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা সহজ কথা নয়।

জয়নাব বিনতে আল হারিথ এবং তাঁর পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে খাইবার অঞ্চলে বসবাস করে আসছিলেন। তাঁরা মূলত ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জয়নাব ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে ছয় শতাধিক নাদির বংশের ইহুদি খাইবারে এসে বসবাস শুরু করে। এরা মুসলমানদের দ্বারা মদিনা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে বসবাস করেছিল। এদের মধ্যে একজন ছিলেন সালাম ইব্ন আল নাদিরি, যার সঙ্গে জয়নাব পরবর্তীতে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন।

৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদের নেতৃত্বে মুসলমানেরা খাইবার অবরোধ করে। এই যুদ্ধে মুসলমানদের আলী বিন তালিব যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দেন। উনিশ দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রথম নয় দিনেই জয়নাব তাঁর স্বামী, পিতা, এবং ভাই, সবাইকে হারান। পরবর্তী দশ দিনে যুদ্ধ বিশেষ কিছু হয়নি, কিন্তু অবরোধ বলবৎ ছিল। মুসলমান বাহিনী বাইরে থেকে সমস্ত পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এমন অবস্থায় ইহুদিদের পক্ষ থেকে কয়েকজন আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে মুহাম্মদের সঙ্গে আলোচনা করতে আসে। 

আলোচনার এক ফাঁকে জয়নাব জেনে নেন, মুহাম্মদের প্রিয় খাবার কী। জয়নাব যখন জানতে পারলেন, ভেড়ার ঘাড়ের মাংস মুহাম্মদের বিশেষ পছন্দের, তখন তিনি তাঁর ভেড়ার পাল থেকে একটা ভেড়া মেরে তার কাঁধের মাংসে ভালো করে বিষ মাখিয়ে সেটাকে রোস্ট করলেন। আত্মসমর্পণের শর্ত নির্ধারণের আলোচনা শেষ হতেই জয়নাব বিষ মাখানো ভেড়ার রোস্ট উপহার হিসেবে মুহাম্মদের সামনে হাজির করলেন।

মুহাম্মদ সামনে রাখা ভেড়ার মাংস থেকে ছোট্ট একটা টুকরো মুখে দিলেন। এদিকে, মুহাম্মদের এক সঙ্গী কিছুটা মাংস চিবিয়ে গিলেও ফেললেন। মুহাম্মদ মাংসটা না গিলে মুখ থেকে ফেলে দিলেন। তারপর বললেন, "এই মাংসে বিষ মেশানো হয়েছে।" এদিকে যিনি মাংসের কিছু অংশ গিলে ফেলেছিলেন, তাঁর মধ্যে বিষক্রিয়া দেখা দিতে শুরু করল। তিনি উঠে দাঁড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না; তাঁর মুখের রং বদলে যেতে থাকল। বিষ মেশানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে একজন একটি মাংসের টুকরো অদূরে অপেক্ষমাণ এক কুকুরকে খেতে দিলেন। মাংস খাওয়ার পরপরই কুকুরটি মারা গেল। উপস্থিত সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল, খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে।

মুহাম্মদ জয়নাবকে ডেকে পাঠালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি এই খাবারে বিষ মিশিয়েছ?" জয়নাব বললেন, "জ্বি, মিশিয়েছি।" মুহাম্মদ পাল্টা প্রশ্ন করলেন, "কেন করলে এই কাজটা?" জয়নাব দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, "আমি আপনাকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছি। আপনি আমার কাছ থেকে আমার পিতাকে কেড়ে নিয়েছেন, আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছেন, আমার গোত্রের অন্য মানুষদেরও কেড়ে নিয়েছেন। আমি আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছি। আমি ভেবেছি, আপনি যদি সত্যিই একজন নবী হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিষ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর আপনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিষ আপনাকে হত্যা করবে।" মুহাম্মদ জয়নাবের যুক্তিকে অস্বীকার করতে পারলেন না, প্রকাশ্যে কেবল এইটুকু বললেন, "আল্লাহ সেটা অনুমোদন করবেন না।"

উপস্থিত মুসলমানেরা জয়নাবের ওপর ক্ষিপ্ত হলেও, মুহাম্মদ তাঁকে হত্যা করার অনুমতি দিলেন না। জয়নাব ফিরে গেলেন। মুহাম্মদ তাঁকে ক্ষমা করলেও জয়নাবের জীবন খুব দীর্ঘায়িত হয়নি। মুহাম্মদের সেই সঙ্গী, যিনি বিষ মাখানো মাংস খেয়েছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যে মারা যান। অবশ্য মৃত্যুর আগের সময়টুকু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েই কাটিয়েছিলেন। বশির আল-বারার মৃত্যুর পর জয়নাবকে তাঁর আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রক্তের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তারা জয়নাবকে হত্যা করে। 

শুরুতে যে বুড়ির কথা বলেছিলাম, মুহাম্মদ যেমন তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন, তেমনি জয়নাব বিনতে আল হারিথকেও ক্ষমা করেছিলেন, যদিও জয়নাবের অপরাধ ছিল আরও গুরুতর। ফলত এই গল্পটাও তাঁর মহানুভবতার আরও বড় নিদর্শন হয়ে উঠতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। আমাদেরকে বারবার সেই বুড়ির গল্পই শোনানো হয়েছে। কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মুহাম্মদের অসুস্থতার মধ্যে। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মুহাম্মদের অসুস্থতার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল এই বিষক্রিয়া। মুহাম্মদ বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন; তিনি বিষ মেশানো মাংসটা গিলে না ফেললেও, বিষের কিছুটা লালার মাধ্যমে তাঁর শরীরে প্রবেশ করেছিল। মৃত্যুশয্যায় মুহাম্মদ প্রায়শই তাঁর জিহ্বা পুড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করতেন। বিভিন্ন উৎস কথা নিশ্চিত করলেও, জয়নাবের বিষপ্রয়োগের ফলেই তাঁর ধরনের শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছিল কিনা, তা বলা মুশকিল। যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে জয়নাব নবীত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, আর সেই সন্দেহের একরকম ভিত্তি তৈরি হয়। এই সন্দেহটা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, তা তাঁর অনুসারীরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। আমার ধারণা, এই কারণেই আমাদের এই গল্পটা শোনানো হয়নি। সেই তুলনায় কাঁটা বিছানো পথ আর বুড়ির গল্প অনেক নিরাপদ।

 

গল্পের ফাঁকফোঁকর : অসম প্রেমের পরিণাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়োগান্তকই হয়েছে। -
Guitar K Kanungo
Dec. 28, 2024 | category | views:62 | likes:3 | share: 2 | comments:0

হিন্দু পুরাণের সঙ্গে গ্রীক পুরাণের একটা অদ্ভুত মিল আছে। এই দুই পুরাণেই অমর দেবতাদের সঙ্গে মরণশীল মানুষের বেশ কিছু যৌন মিলনের ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেবতারাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, মরণশীল মানব বা মানবীর তাদের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে একজন মানব একজন মানবীতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মহাভারতে নল-দময়ন্তীর কথা বলা হয়েছে; একইভাবে ইলিয়াডে বলা হয়েছে ওডিসিউস এবং পেনেলোপের কথাও।

রামায়ণ এবং মহাভারতে অজস্র উদাহরণ আছে। রামায়ণ দিয়েই শুরু করি। ঋষি বিশ্বামিত্র মেনকা নামের এক অপ্সরার সঙ্গে মিলিত হলেন। অপ্সরারা স্বর্গ-বেশ্যা; তাঁর সুন্দরী হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু বিশ্বামিত্রের কাছে এই গোটা ব্যাপারটা ছিল একটি ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। মিলনের পর তিনি তাঁর নিজের পথে চলে গেলেন, আর মেনকাও সন্তান জন্ম দিয়ে তাঁর নিজের পথে, অর্থাৎ স্বর্গে ফিরে গেলেন। এদের মিলনের ফলে যে সন্তানটির জন্ম হলো, তিনি ভুবনবিখ্যাত—তাঁর নাম শকুন্তলা। এই শকুন্তলা এবং দুষ্মন্তের সন্তান ভরতের নামেই আমাদের ভারতবর্ষের নামকরণ হয়েছে।

আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে অপ্সরারা মর্ত্যভূমিতে থেকে গেছেন এবং একেবারে ঘর-সংসার করেছেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাথে নির্দিষ্ট এক সময় পর্যন্ত। অপ্সরা উর্বশীর কথাই ধরা যাক। তিনি কুরুবংশের পূর্বপুরুষ রাজা পুরুরুবার প্রেমে পড়ে স্বর্গভূমি ছেড়ে এসেছিলেন। তবে এই ছেড়ে আসার একটি শর্ত ছিল, এবং সেই শর্তভঙ্গ হওয়ার কারণে তিনি আবার পুরুরুবাকে ছেড়ে স্বর্গে ফিরে গিয়েছিলেন। তাদের মিলনের ফলে আয়ু নামের এক সন্তানের জন্ম হয়, যিনি উপযুক্ত সময়ে পুরুরুবার স্থলাভিষিক্ত হন।

পিতামহ ভীষ্মের পিতা শান্তনুর ক্ষেত্রেও একইরকম ঘটনা ঘটেছিল। ভীষ্মের জননী গঙ্গা সাধারণ মানবী ছিলেন না; তবে তিনি অপ্সরাও ছিলেন না। দেবী গঙ্গা শর্তসাপেক্ষে মহারাজ শান্তনুর ঘরণী হতে সম্মত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও একটি শর্ত ছিল—দেবী গঙ্গা তাঁর কোনো কাজের জন্য কাউকে, এমনকি মহারাজ শান্তনুকেও, জবাবদিহি করবেন না। এই শর্ত ভঙ্গ হলে তিনি শান্তনুকে ছেড়ে চলে যাবেন। দেবব্রতের জন্মের আগে গঙ্গার গর্ভে সাতটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল, যাদের প্রত্যেককে তিনি নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন। কেন তিনি এমন নিষ্ঠুর কাজ বারবার করে চলেছেন, এই প্রশ্ন তুলেই মহারাজ শান্তনু শর্ত ভঙ্গ করেছিলেন, যার ফলে দেবী গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আমরা যাকে উষা বলি, গ্রীকরা সেই ঊষাকে এওস নামে ডাকে। দেবী এওস ট্রোজান রাজকুমার টিথোনাসের প্রেমে পড়ে যান। প্রেমে পড়ারই কথা, কারণ টিথোনাস ছিলেন যেমন স্বাস্থ্যবান, তেমন সুদর্শন। সৌন্দর্যের বিচারে দেবী এওসও কম যান না। অতএব, চার চক্ষুর মিলন হলো। কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই গেল। এওস দেবী, কিন্তু টিথোনাস মরণশীল মানুষ। এই সমস্যার সমাধান করতে দেবী এওস দেবরাজ জিউসের কাছে হাজির হয়ে টিথোনাসকে অমর করে দেওয়ার আবেদন জানালেন। দেবরাজ জিউস নিজেও অনেক মানবীর প্রেমে পড়েছেন, অতএব তিনি এওসের অনুভূতিটা বুঝতে পারলেন। এওসের আবেদন মঞ্জুর হলো। কিন্তু এখানেই একটা বিপত্তি ঘটল। কী বিপত্তি ঘটল, সেটা একটু পরে বলছি। তার আগে আরেকটি ঘটনার কথা বলে নিই।

এলসিমেনে ছিলেন তিরিনসের রাজকুমার এমফিতরাইয়োর স্ত্রী। রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। দেবরাজ জিউসের বেশ ভালো লেগে গেল এলসিমেনেকে। রূপবতী নারী দেখলেই জিউসের ভালো লাগে। রাজকুমার এমফিতরাইয়ো যখন অন্যত্র যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, তখন জিউস এমফিতরাইয়োর রূপ ধারণ করে এলসিমেনের কাছে হাজির হলেন। এলসিমেনে ধরে নিয়েছিলেন স্বামী যুদ্ধ থেকে ফিরেছেন, এমফিতরাইয়োর কোনো আচরণ তাঁর মনে কোনো রকমের সন্দেহের উদ্রেক করেনি। যথাসময়ে তাঁরা মিলিত হলেন। এই ঘটনার সঙ্গে ইন্দ্র এবং অহল্যার মধ্যকার ঘটনার বেশ মিল আছে, একটি ব্যাপার ছাড়া। এলসিমেনে মানবগর্ভজাত হলেও অহল্যাকে অনেকটা প্যান্ডোরার সঙ্গে তুলনা করা চলে—যাঁকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মানবী করে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।

এলসিমেনের ক্ষেত্রে না ঘটলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, দুই পুরাণেই এই ধরনের অসম প্রেমের পরিণতি ভালো হয়নি, সেকথাই বলা হয়েছে। জিউস তাঁর যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য মর্ত্যের নারীদের পেছনে ঘোরাঘুরি করলেও এবং এই সমস্ত মিলনের ফলে কখনো কখনো ভুবনখ্যাত সন্তানের জন্ম হলেও (এলসিমেনে যে সন্তানের জন্ম দেবেন, তার নাম হারকিউলিস, যিনি অনেক অসাধ্য সাধন করবেন এবং নিজের যোগ্যতায় দেবতার পদমর্যাদা লাভ করবেন), অনেক ক্ষেত্রে জিউসের লালসার শিকার সেই নারীদের জিউসের স্ত্রী হেরার আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে।

দেবী এওস এবং টিথোনাসের কথা আগেই বলেছি। এওস টিথোনাসকে অমরত্ব দিলেও চিরযৌবনের অধিকারী করার আবেদন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ফলে এওস যৌবনবতী থেকে গেলেও টিথোনাস এক পর্যায়ে বুড়িয়ে যেতে শুরু করেন। শরীরের আবেদন ফুরিয়ে যেতেই প্রেমেরও সেখানে সমাপ্তি ঘটে।

হিন্দু পুরাণের ঘটনাগুলোও তেমন। ইন্দ্র এবং অহল্যার মিলনের ফলে হারকিউলিসের মতো কোনো সন্তানের জন্ম হয়নি, বরং দুজনেই অভিশাপ কুড়িয়েছেন। অহল্যা ইন্দ্র দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, এমন দাবি করলেও তাঁর স্বামী গৌতম অহল্যার কথা বিশ্বাস করেননি। এদিকে, ইন্দ্র তো হাতেনাতেই ধরা পড়েছিলেন। অপকর্মের দায় থেকে মুক্তি না পেয়ে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। ইন্দ্র যেহেতু দেবতা, দেবতাদের রাজা, সেহেতু গৌতমের অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে পারলেও অহল্যাকে রূপ-যৌবন হারিয়ে পাথর হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল হাজার বছর।

উর্বশী পুরুরুবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, একই কাজ করেছিলেন গঙ্গাও। তিনি শুধু চলেই যাননি, তাঁর গর্ভজাত সব সন্তানকেও নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেবব্রতকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল বিশ্বামিত্র এবং মেনকার ক্ষেত্রে। শকুন্তলাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন মেনকা। বিশ্বামিত্র জানতেনই না যে তাঁর একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। কণ্ব মুনি সেই মেয়েকে কুড়িয়ে পেয়ে বড় করে তুললেও দুর্ভাগ্য শকুন্তলার পিছু ছাড়েনি। রাজরানী হওয়া সত্ত্বেও রাজপাঠে বসার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। উল্টো, সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে।

দেবতা ও মানুষের এই ধরনের অসম প্রেমের পরিণতি প্রায় সবক্ষেত্রেই বিপর্যয়মূলক হলেও, এই প্রেম থামেনি। দুই পুরাণে যেসব ঘটনা এখানে আলোচনা করা হয়েছে, এর বাইরেও অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেগুলোকেও ধর্ষণ বলা চলে। গ্রিক দেবতা পোসাইডন মেডুসার সঙ্গে যা করেছেন, সেটাকে ধর্ষণই  বলতে হবে। মুশকিলের ব্যাপার হলো, ধর্ষিতা হয়েও ধর্ষণের দায়টা ধর্ষিতাকেই নিতে হয়েছে। মেডুসা তার উদাহরণ। এথেনা মেডুসাকে অভিশাপ দিলেও পোসাইডনকে কোনো শাস্তি দেননি। হয়তো এথেনার ক্ষমতা ছিল না পোসাইডনকে শাস্তি দেওয়ার।

সুখের কথা, হিন্দু পুরাণে ধর্ষণের শাস্তি দুপক্ষকেই ভোগ করতে হয়েছে। অহল্যা এবং ইন্দ্রের ক্ষেত্রে, সহজভাবে চিন্তা করলে অহল্যা ধর্ষিত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে ইন্দ্র একজন ধর্ষক। আবার একটু জটিলভাবে ভাবলে দেখা যায়, অহল্যা তাঁর যৌন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলত, তিনি ইন্দ্রকে কামনা করেছেন। তবুও ইন্দ্র অপরাধ করেছেন, কারণ তিনি নিজে বিবাহিত এবং যাঁর কামনা পূরণ করতে গেছেন, তিনিও বিবাহিত। অতএব, শাস্তি ইন্দ্রকেও পেতে হয়েছে।  পোসাইডনের মত ইন্দ্র পার পেয়ে যাননি ; শাস্তির মাত্রা কমাতে তাঁকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।    




ইতিহাসের ফাঁকফোঁকর : পুত্রের জন্য পিতার জীবনদান। -
Guitar K Kanungo
Dec. 27, 2024 | category | views:175 | likes:3 | share: 3 | comments:0

সম্রাট হলেও তিনি যে একজন স্নেহময় পিতা এই ব্যাপারটা প্রমান করেছিলেন মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। সম্রাট তখন দিল্লীতে, কিছুটা অসুস্থ বোধ করছেন। দিল্লীর আবহাওয়া এমনিতেই বিশেষ রকমের অস্বস্তিকর, বিশেষ করে সেই সম্রাটের জন্য, যিনি তাঁর জীবনের চল্লিশ বছরেরও বেশী সময় কাটিয়েছেন ফারগানা, সমরখন্দ এবং কাবুলের মত তুলনামূলক শীতল জায়গায়।


বাবুরের পুত্র হুমায়ুন তখন সাম্রাজ্যের আরেক প্রান্ত কাবুলে অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখানকার শাসনকর্তা। পিতার অসুস্স্থতার খবর শুনে তিনি সম্রাটের পূর্বানুমতি না নিয়েই দিল্লী এসে উপস্থিত হলেন। বাবুর হুমায়ূনের এইভাবে কাবুল ত্যাগ করে দিল্লিতে এসে হাজির হওয়াটা ঠিক পছন্দ করতে পারলেন না। তাঁর আশংকা ছিল হুমায়ুনের অনুপস্থিতে কাবুলের মসনদ অন্যের দখলে চলে যেতে পারে। বাবুর হুমায়ূনকে অবিলম্বে কাবুল ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন।

হুমায়ূনের পিতার নির্দেশ না মেনে কোন উপায় ছিল না। তিনি দিল্লী থেকে কাবুলের উদেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। দিল্লী থেকে কাবুলের দূরত্ব প্রায় একহাজার কিলোমিটার; এই দূরত্ব পাড়ি দিতে সেইসময় প্রায় মাসখানেক সময় লাগত। যাই হোক, আগ্রা পৌঁছাতে না পৌঁছাতে এবার হুমায়ুন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দিল্লী থেকে আগ্রার দূরত্ব প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার। তখনকার দিনে এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পাঁচ থেকে ছয়দিন সময় লেগে যেত। হুমায়ুনের অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকল।  একপর্যায়ে এতটাই অবনতি হল যে আগ্রা থেকে দিল্লীতে খবর পাঠানো হল যেন সম্রাজ্ঞী মাহাম বেগমকে আগ্রায় পাঠানো হয়। পুত্রের এই পর্যায়ের অসুস্থতার খবর শুনে সম্রাজ্ঞী তো বটেই, সম্রাট বাবুর নিজেও অবিলম্বে আগ্রা এসে পৌঁছালেন।

তারপর সেই ইতিহাস-বিখ্যাত ঘটনাটা ঘঠল। প্রচলিত সব রকমের চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করার পরও হুমায়ূনের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হল না। সম্রাট বাবুর সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর জীবনের বিনিময়ে তাঁর পুত্রের জীবন ভিক্ষা চেয়ে প্রার্থনা করলেন। তখন সম্রাট বাবুরের বয়স তখনো পঞ্চাশও হয়নি ;  নিজের প্রাণ উৎসর্গ করবার মত বয়স সেটা মোটেও নয়। প্রাচীন ভারতের আরেক রাজা যযাতির মত জীবনকে আরো অনেকটা সময় ধরে উপভোগ করার প্রয়োজনে সন্তানদের সঙ্গে নিজের জরা বিনিময় করার বদলে সন্তানের জীবনের বিনিময়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়েছেন। 

ইতিহাস বলছে ঈশ্বর বাবুরের সেই আবেদন গ্রহণ করেছিলেন, অন্তত কার্যত সেরকমই ঘটতে দেখা গেছে। ধীরে ধীরে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে উঠবেন। অন্যদিকে বাবুর ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকবেন। বিপ্রতীপ এই দুটি ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের আদৈ কোন ভূমিকা আছে কিনা সেটা বলা মুশকিল, যদিও বাবুরের জীবনীকারেরা ব্যাপারটাকে সেভাবেই দেখতে চেষ্ঠা এবং দেখাতে করেছেন। গোটা ব্যাপারটাকে একটা অধ্যাত্বিকতার মোড়কে মুড়ে সম্রাটকে একজন অত্যন্ত নিষ্টাবান এবং ধার্মিক পুরুষ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা।    

হতে পারে গোটা ব্যাপরটা একটা কাকতাল মাত্র। হুমায়ুন কিছুটা দেরীতে হলেও যে সমস্ত ঔষুধ তাঁকে দেয়া হয়েছিল, সেইসব ঔষুধে সাড়া দিতে শুরু করেছিলেন । অন্যদিকে বাবুর নিজে যে খুব একটা সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন সেকথা বলা যাবে না। তিনি যথেষ্ঠ পরিমানে সূরাসক্ত ছিলেন। তাঁর নিশ্চয়ই কোন শারীরিক সমস্যা ছিল  একমাত্র উত্তরাধিকারকে হারিয়ে ফেলার যে একটা তীব্র উৎকণ্ঠা সেটা হয়ত তাঁকে শারীরিকভাবে আরো অসুস্থ করে তুলতে পারে।         

বাবুর এবং হুমায়ূনের মধ্যকার এই ঘটনার মধ্যে যে কোন অলৌকিকতা নেই, কোন অধ্যাত্বিকতার লেশমাত্র নেই, সেটা বোঝার জন্য আমাদের সময়ের পরিক্রমায় হাজারখানেক বছর পিছিয়ে যেতে হবে। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা  মুহাম্মদের পুত্র ইব্রাহীম অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী। হুমায়ূনের মত মুহাম্মদও একজন পিতা হিসেবে আল্লাহর কাছে তাঁর সন্তানের জীবন ভিক্ষা করেছিলেন;  কিন্তু আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেননি । 

ইব্রাহীম বিন মুহাম্মদ মাত্র দুইবছর বয়সেই মৃত্যু বরণ করবে এবং তাঁর অল্পকয়েক দিন পরেই তার পিতা মুহাম্মদেরও মৃত্যু হবে। ঈশ্বর চাইলেই হুমায়ূনের মত ইব্রাহীমের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারতেন, তার  পিতা মুহাম্মদের জীবনের বিনিময়ে। আল্লাহ স্বয়ং যাকে মনোনীত করেছেন নবী হিসাবে, সেই মুহাম্মদের আবেদনই যেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেখানে বাবুরের আবেদন গৃহীত হয়েছিল এমনকরে ভাবার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই।

 


গল্পের ফাঁকফোঁকর : বিভীষনকে চিরঞ্জিবী হবার বর দিয়ে রামচন্দ্র বুদ্ধির পরিচয় দেননি। -
Guitar K Kanungo
Dec. 26, 2024 | category | views:60 | likes:2 | share: 3 | comments:0

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, সাতজন চিরঞ্জীবী আছেন, অর্থাৎ এরা মৃত্যুকে জয় করেছেন। পুরাকালে অনেক অসুর এটাই চেয়েছিলেন, অবশ্য সঙ্গে কিছুটা শক্তিও, কিন্তু বিধাতা পুরুষ তাদের একজনকেও চিরঞ্জীবী হয়ে উঠতে দেননি। তিন বিধাতার মধ্যে যিনি সবচাইতে ভোলাভালা বলে পরিচিত, সেই ভোলানাথকেও অসুরেরা ভোলাতে পারেনি। অথচ এমন নয় যে তপস্যার জোর এদের কিছু কম ছিল।

ঈশ্বরের কাছে সব সৃষ্টিই সমান—সুর কিংবা অসুর। তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে 'ডিস্ক্রিমিনেট' করবেন, এমন ভাবার সুযোগ নেই। তাই ধরে নিতে হবে, অসুরদের চিরঞ্জীবী হয়ে উঠতে না দেবার পেছনে একটা শক্ত কোনো কারণ রয়েছে। যে সমস্ত অসুর অমরত্বের বর পেয়েও মৃত্যুকে এড়াতে পারেনি, তাদের পক্ষে ঈশ্বরের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারা সম্ভব না হলেও, আমরা কারণটা অনুমান করতে পারি। এটা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ; জন্মিলে মরিতে হইবে—এটাই প্রকৃতির নিয়ম। স্বয়ং ঈশ্বরও এই নিয়মের অধীন।

যদি তাই হয়, তাহলে ঈশ্বর পরশুরাম, বিভীষণ, ব্যাস, বালী এবং হনুমানের ক্ষেত্রে প্রকৃতির এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে দিলেন কেন, যেখানে তিনি নিজেই বলছেন তিনি প্রকৃতির নিয়মে আবদ্ধ? কিংবা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা অথবা আচার্য কৃপের ক্ষেত্রে? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এবং সেই প্রশ্ন আমি তুলতে চাইছি এখানে, কারণ এই প্রশ্ন তোলার একটা অত্যন্ত গুরুতর কারণও আছে—আর সেটা হচ্ছে মোক্ষলাভের প্রসঙ্গ। প্রতিটি মানুষের মোক্ষলাভের অধিকার হিন্দু ধর্মে স্বীকৃত।

দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) চিরঞ্জীবী হতে চাননি। শাস্তি হিসাবে তাদের এই দুর্ভাগ্যকে বরণ করতে হয়েছে। অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছিলেন। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রথমে পাণ্ডবদের পাঁচ সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, যে সন্তানটি তখনো অনাগত, অভিমন্যুর স্ত্রী উত্তরার গর্ভের সেই সন্তানটিকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এই অপরাধ অত্যন্ত গর্হিত এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য।

অভিশাপ কুড়োবার মতোই অপরাধ ছিল। বাসুদেব কৃষ্ণ, যিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার, তিনি অশ্বত্থামা (এবং কৃপাচার্য) কে এই বলে অভিশাপ দিলেন যে তারা অনন্তকাল ধরে এই অপকর্মের অপরাধবোধ বয়ে বেড়াবে। শুধু তাই নয়, তারা অসহনীয় দুঃখ এবং কষ্টের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াবে। তাদের ঘৃণ্য অপরাধের কথা সবাই মনে রাখবে, এবং সেইজন্যই তারা কোথাও কারো কাছে দু'দণ্ড আশ্রয় পাবে না। দুঃখ, কষ্ট আর একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুকে হাজার ডাকলেও, মৃত্যু তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে না। মোক্ষ লাভের প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। 

এটুকু পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন, এবং সেই শাস্তি দিতে গিয়ে তিনি প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করেছেন; তিনি সেটা করতেই পারেন, যেহেতু তিনি স্বয়ং ঈশ্বর। তিনি সমস্ত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। গোলমালটা বাঁধে যখন আমরা হনুমান (এবং বিভীষণ) কে চিরঞ্জীবী হতে দেখি। একই প্রশ্ন বালী এবং পরশুরামের ক্ষেত্রেও উঠবে, কিন্তু তাঁরা যেহেতু ঈশ্বরেরই অবতার, এই আলোচনা থেকে তাঁদেরকে বাদ দিলাম, কারণ অনেকেই হয়তো বলবেন দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য তাঁদের সর্বকালীন উপস্থিতির প্রয়োজন আছে। যদিও তাঁদের সেরকম কোনো উপস্থিতি কোথাও ঠিক চোখে পড়ছে না, অথচ পৃথিবীতে অনাচার, অবিচার অবিরাম ঘটেই চলেছে।

কিন্তু হনুমান এবং বিভীষণের চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠার কী প্রয়োজন ছিল বা এখনো আছে, সেই ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। দুজনেই ভগবান বিষ্ণুর আরেক অবতার শ্রীরামচন্দ্রের কাছ থেকে অমরত্বের বর পেয়েছেন। এটা যেহেতু বর, এবং অশ্বত্থামার মতো তাঁদের মনে কোনো অপরাধবোধও নেই, অনুমান করা যেতে পারে যে তাঁরা তাঁদের পছন্দমাফিক জায়গায় অবস্থান করছেন, এবং জরা-ব্যাধি এসবের কোনো কিছুই তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি।

এরপরেও কি তাঁরা ভালো আছেন? একাকীত্বের বোঝা তাঁরা ঠিকঠাক বইতে পারছেন তো?  ওয়াশিংটনের আরভিঙের রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের গল্পটা  এখানে প্রাসঙ্গিক। অদ্ভুদ কিছু মানুষের পাল্লায় পড়ে, তাদের দেয়া পানীয় থেকে কয়েক যুগ ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে যখন রিপ ভ্যান উইঙ্কেল বাড়িতে ফিরে এলেন, ততদিনে তাঁর গ্রামের সবকিছু বদলে গেছে। ভাগ্যিস তাঁর ছোট্ট মেয়েটা যে কিনা ততদিনে অনেকে বড় হয়ে গেছে, সে রিপকে চিনতে পেরেছিল। ভাগ্যিস চিনতে পেরেছিল ! বাকী জীবনটা রিপ ভ্যান উইংকেল নাতি-নাতিনীদের গল্প শুনিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। কী ঘটছে হনূমান আর বিভীষণের বেলায় ? হনুমান তবু দুচারটে মন্দিরে পূজিত হন, এর কোন একটায় গিয়ে আশ্রয় নিলে দুচারজন ভক্তের কথাবার্তা তিনি হয়তো শুনতে পান, তাঁর অসীম একাকীত্বের কিছুটা হলেও কেটে যায়। কিন্তু বিভীষণ কী করছেন? এখন তো সেই রামও নেই, সেই লঙ্কাও নেই!

বর নামে চালানো হলেও গোটা ব্যাপারটা তাঁদের জন্য এক অর্থে অভিশাপ হয়ে গেল না? কী মূল্য আছে এই অর্থহীন বেঁচে থাকার? বিশেষ করে যদি বিভীষণের কথা বলি। লঙ্কার যে অবস্থা—কেউ বলে আজকের শ্রীলঙ্কা, আবার কেউ বলে আজকের মালদ্বীপ—রাবণের শ্রীলঙ্কা ! দুটি দেশের কোনো একটি বিশেষ ভালো অবস্থায় নেই। শ্রীলঙ্কা মাত্র কিছুদিন আগে অনেক কষ্টে দেউলিয়া অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে, মালদ্বীপের লোকজন মাছ ধরেই দিন কাটায়। সেটাও কতদিন করতে পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে—এই দ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেকোনো সময় পানির নিচে চলে যেতে পারে। আমার তো ধারণা, সুযোগ থাকলে অন্তত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এবং বিভীষণ এতদিনে মানুষের আদালতে ইচ্ছামৃত্যুর জন্য আবেদন করতেন।

শ্রীরামচন্দ্র যে তাঁদের মোক্ষলাভের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করেছেন, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় যে, আসলে শ্রীরামচন্দ্র দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার কারণে প্রকারান্তরে বিভীষণকে শাস্তিই দিয়েছেন, অশ্বত্থামার আদলে? দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছোট কোনো অপরাধ নয়। বিভীষণের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই অনেক মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে। সোনার লঙ্কা ট্রয় নগরীর মতো ধ্বংস হয়ে গেছে। হতে পারে, কিন্তু হনুমান এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের ক্ষেত্রে তাঁদের মোক্ষলাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার কারণটা কী ? এদের দুজন মোটাদাগে কোন অপরাধ করছেন, এমন কথা তো কোথাও চোখে পড়ে নি, অন্তত হনুমানের ক্ষেত্রে তো নয়ই ! নিয়োগ পদ্ধতিতে সন্তান উৎপাদন করতে গিয়ে ব্যস, যদি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখি, তাহলে কিছুটা যৌন-বিকৃতির পরিচয় দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটাকে অপরাধ বিবেচনা করা চলে না। তাহলে? চিরঞ্জীবিদের  চিরঞ্জীবী হয়ে ওঠার এই গোটা ব্যাপরটাই আসলে কেমন যেন গোলমেলে   


গল্পের ফাঁকফোঁকর : নরাণাং মাতুলক্রম। -
Guitar K Kanungo
Dec. 23, 2024 | category | views:66 | likes:5 | share: 2 | comments:0
সংস্কৃতে একটা কথা আছে - "নরাণাং মাতুলক্রম," অর্থাৎ মানুষ মাতুলদের প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ভাগ্নেদের মধ্যে মামাদের স্বভাবের প্রতিফলন দেখা যায়। এই শব্দ যুগল প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল মহাভারতে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতি নকুল ও সহদেবের মামা শল্যকে নিরুৎসাহিত করতে কর্ণ বিদ্রূপভরে এই উক্তি করেছিলেন। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসকালে বিরাটরাজের আশ্রয়ে প্রথম তিন ভাই উচ্চপদ পেলেও, নকুল ও সহদেব যথাক্রমে অশ্বরক্ষক ও গোরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। কর্ণ সেই দিকেই ইঙ্গিত করতে গিয়ে এই শ্লেষোক্তি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তীতে প্রবাদে পরিণত হয়।  

তবে এই উৎস-কাহিনী বলার জন্যে এই গল্পের অবতারণা করা হয়নি। আজকের গল্প হিন্দু পুরাণের মহত্তম দুই পুরুষকে নিয়ে। এঁদের প্রথম জন মহর্ষি বিশ্বামিত্র, দ্বিতীয় জন ভার্গব পরশুরাম। দুজনের মধ্যে বিশ্বামিত্রকে আমি ব্যাক্তিগতভাবে রীতিমত এডোর করি । বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মালেও তপস্যার জোরে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠেছিলেন। এই ঘটনা গোটা হিন্দু পুরাণে একবারই ঘটেছে। অন্যদিকে পরশুরাম এই পৃথিবীকে একুশবার ক্ষত্রিয়শূন্য করেছিলেন। এই পরশুরাম ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের একজন। শুধু তাই নয়, তিনি সাত ইমমর্টালদের মধ্যে একজনও বটে। মজার ব্যাপার হল, এই দুই মহত্তম পুরুষের মধ্যে 'নরাণাং মাতুলক্রম' ব্যাপারটার একটা সম্পর্ক আছে।

প্রাচীন ভারতে কন্যকুব্জ নামের একটি রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের গাধী নামের এক প্রখ্যাত রাজা ছিলেন। বিশ্বামিত্র ছিলেন এই গাধীর সন্তান। একজন ক্ষত্রিয় রাজকুমার। বাল্মিকী রামায়ণে বিশ্বামিত্র অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি চরিত্র। তিনি ছিলেন অযোধ্যার রাজপুত্র, বিশেষ করে রাম এবং লক্ষণের অস্ত্রগুরু। এই বিশ্বামিত্রই রাম এবং লক্ষণকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মিথিলায়, রাজা জনকের রাজধানীতে। এখানেই হরধনু ভঙ্গ করে রাম সীতার সঙ্গে এবং লক্ষণ উর্মিলার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। বিশ্বামিত্র যদি এই রাজকুমারদের মিথিলায় নিয়ে না আসতেন, তাহলে রামচন্দ্রের সঙ্গে জানকীর দেখা হত না। পরবর্তীতে সীতাহরণের ঘটনাও ঘটত না, এবং সীতাহরণের ঘটনা না ঘটলে গোটা রামায়ণটাই আসলে লেখা হত না। শুধু তাই নয়, এই মিথিলায় এসে হরধনু ভঙ্গ করেছিলেন বলে ভগবান বিষ্ণুর দুই অবতার, রাম এবং পরশুরামের মধ্যে সাক্ষাৎকারের মতো বিরল ঘটনার ঘটবার সুযোগ সৃষ্টি হত না। 

পরশুরাম ছিলেন মহর্ষি জমদগ্নির পুত্র। তাঁর মায়ের নাম ছিল রেণুকা। জমদগ্নির পিতার নাম ছিল মহর্ষি রিচিক। এই ঋচীকের স্ত্রী ছিলেন বিশ্বামিত্রের বোন, তথা রাজা গাঁধীর কন্যা সত্যবতীর স্বামী। অর্থাৎ সত্যবতী ছিলেন পরশুরামের পিতামহী। বিশ্বামিত্র সত্যবতীর ভাই। সেই হিসাবে, সম্পর্ক অনুযায়ী, বিশ্বামিত্র পরশুরামের পিতামহ। সেইজন্যেই শুরুতেই বলেছিলাম, ঋষিপুত্র হয়ে জন্মালেও, সত্যবতীর বংশধারার উত্তরপুরুষ হিসেবে পরশুরামের মধ্যে ক্ষত্রিয়ের গুণাবলী লক্ষণীয়ভাবে ছিল। শুধু কি তাই? পরশুরাম জননী রেণুকাও ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত। মজার ব্যাপার হলো, পরশুরাম ব্রাহ্মণ হয়ে ক্ষত্রিয় বিনাশে উদ্যোগী হবেন, অন্যদিকে বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় হয়েও ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবেন।  

বিশ্বামিত্র তখনো বিশ্বামিত্র হয়ে ওঠেননি, তিনি ক্ষত্রিয় রাজা হয়ে রাজ্যপাট সামলাচ্ছিলেন। সবার কাছে তখন রাজা কৌশিক নামে পরিচিত ছিলেন। একদিন সসৈন্যে মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলেন। আগেকার দিনের রাজাদের এই মৃগয়া করার ব্যাপারটা ছিল অন্যতম এক বিনোদন। ঘুরতে ঘুরতে মহারাজ কৌশিক মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে এসে পৌঁছালেন। বশিষ্ঠ আগত অতিথিদের যথাবিহিত সমাদর করলেন। কিন্তু মহারাজ কৌশিক অবাক হলেন, মহর্ষি বশিষ্ঠ কীভাবে এতজন অতিথিকে এভাবে রাজোচিত সমাদর করতে পারলেন। মহারাজ কৌশিক জানতে পারলেন, বশিষ্ঠের এই অপরিমেয় প্রাচুর্যের পেছনে ছিল কামধেনু নামের একটি স্বর্গীয় গাভী।

মহারাজ কৌশিক বশিষ্ঠের কাছে সেই কামধেনুটিকে চাইলেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে। কিন্তু বশিষ্ঠ রাজি হলেন না। কৌশিক এবার সেই কামধেনুটিকে বশিষ্ঠের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। বশিষ্ঠের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কাছে মহারাজ কৌশিক পরাজিত হলেন। কৌশিক এই পরাজয়কে ব্রাহ্মণ্য শক্তির কাছে ক্ষাত্রশক্তির পরাজয় হিসেবেই ধরে নিলেন। বশিষ্ঠের আশ্রম ত্যাগ করে তিনি কঠোর তপস্যায় বসলেন। সেই তপস্যা শেষ হল প্রজাপতি ব্রহ্মা এসে তাঁকে ব্রাহ্মণ পদে উত্তীর্ণ না করা পর্যন্ত। ক্ষত্রিয় রাজা কৌশিক সেদিন থেকে মহর্ষি বিশ্বামিত্র হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। জন্মসূত্রে পাওয়া নিজের বর্ণ পাল্টে ফেলার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম এবং শেষবারের মত ঘটল।

পরশুরামের ক্ষত্রিয় বিনাশকারী হয়ে ওঠার পেছনেও এই কামধেনু সংক্রান্ত গোলযোগই প্রধানত দায়ী। দুটি ঘটনাই প্রায় একইরকম। শুধু স্থান, কাল, পাত্র আলাদা। বশিষ্ঠের জায়গায় মহর্ষি জমদগ্নি; ক্ষত্রিয় রাজা কৌশিকের জায়গায় ক্ষাত্রবীর্যার্জুন। তবে সংঘর্ষের ফলাফলে সামান্য তফাৎ আছে, আর সেটা হল কামধেনু জোর করে কেড়ে নিতে গিয়ে বিশ্বামিত্র পরাজিত হয়েছিলেন বশিষ্ঠের কাছে, অন্য ঘটনায় মহর্ষি জমদগ্নি ক্ষাত্রবীর্যার্জুনের কাছে পরাজিত এবং নিহত হয়েছিলেন। আগেই বলেছি, পরশুরাম ছিলেন এই ঋষি জমদগ্নির পুত্র। পিতা হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ক্ষাত্রবীর্যার্জুন তো বটেই, আরো অসংখ্য ক্ষত্রিয় রাজাকে একের পর এক হত্যা করেন এবং তা চলতে থাকে অনেক বছর ধরে।

কামধেনু কীভাবে দুই সময়ের দুইজন ঋষির অধিকারে গেল, যাদের মধ্যে বংশ পরম্পরার কোনো সম্পর্ক নেই, এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এমনকি, এইরকম অসাধারণ দৈবশক্তিসম্পন্ন একটি গাভী আদৌ থাকতে পারে কিনা সেটাও প্রশ্নের বিষয়। কিন্তু এই দুটি ঘটনা থেকে যে বিষয়টি বোঝা যায়, তা হলো প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে একটি লড়াই ছিল। সেই লড়াইয়ে কখনো ব্রাহ্মণ্য শক্তি জয়লাভ করেছে, আবার কখনো ক্ষত্রিয় শক্তি। বশিষ্ঠের সঙ্গে বিরোধ না হলে বিশ্বামিত্রের 'বিশ্বামিত্র' হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। একইভাবে জমদগ্নির সঙ্গে ক্ষাত্রবীর্যার্জুনের বিরোধ না হলে পরশুরামের ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হয়ে ওঠা সম্ভব হত না। লোভে পড়ে একজন নিরীহ, নিরস্ত্র ব্রাহ্মণকে হত্যা করার ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে ক্ষাত্রশক্তি দুর্বিনীত, বেপরোয়া, এবং দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে উঠেছিল। এদের দমন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল, এবং ভগবান পরশুরাম সেই কাজটিই করেছিলেন।

তবে বিশ্বামিত্রের ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠা মানবজাতির জন্য অনেক বেশি প্রেরণাদায়ক। এই দুই মহাপুরুষের জন্মের ঘটনায় কিছু রহস্যের কথা বলা হয়েছে—এক স্বর্গীয় পায়েস থেকেই এঁদের দুজনের জন্ম। কিন্তু এদের জননীদের ভুলের কারণে, যার ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মাবার কথা ছিল, তিনি ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মেছেন, আর যার ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মাবার কথা, তিনি ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছেন। ফলে জীবনের একটি পর্যায়ে এঁদের বর্ণ পরিবর্তনের বিষয়টি পূর্বনির্ধারিত হলেও, বিশ্বামিত্রকে কঠোর তপস্যা করতে হয়েছে ব্রাহ্মণ হয়ে উঠবার জন্য। অন্যদিকে, পরশুরামকে একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয় করতে গিয়ে নিজেকেই বারবার ক্ষত্রিয় করে তুলতে হয়েছে। এই নিজের বর্ণ পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন যে আরেক চিরঞ্জীবী হনুমান এসে তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন—যথেষ্ট হয়েছে, এবার তাঁকে থামতে হবে; ক্ষত্রিয়বিহীন পৃথিবী ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।

   

গল্পের ফাঁকফোঁকর: অভিশপ্ত কেতকী ফুল -
Guitar K Kanungo
Dec. 22, 2024 | category | views:77 | likes:3 | share: 2 | comments:0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা’য় সম্ভবত কেতকী মিত্রের নামটি পেয়েছিলাম, কিন্তু কেতকী নামের যে একটি ফুলও আছে, সে কথা জানা ছিল না। আবার সেই ফুল যে অভিশপ্ত, সেটিও সম্প্রতি জানলাম। শিব পুরাণ পড়ছিলাম, সেখানেই কেতকী ফুলের অভিশাপ কুড়ানোর গল্পটি পড়লাম। বিশেষ একটি কারণে এই গল্পটি বলার মতো; সেই কারণটি পরে বলছি, আগে গল্পটি বলে নিই।

রাম ও সীতা বনবাসে আছেন, সঙ্গে লক্ষণ। রাম বনবাসে যাওয়ার কিছুদিন পরেই দশরথের মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সময় এল। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য উপকরণ প্রয়োজন; রাম লক্ষণকে পাঠালেন আশপাশ থেকে কিছু উপকরণ সংগ্রহ করতে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু লক্ষণ ফিরল না। রাম চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে তো বসে থাকা যায় না, এবার রাম নিজেই বেরিয়ে পড়লেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো—রাম কিংবা লক্ষণের কারোরই দেখা নেই। সীতা কুটিরে একা। এদিকে শ্রাদ্ধের সময়ও পার হয়ে যাচ্ছে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। সীতা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনিই পিতৃগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করবেন। তিনি পাশের ফল্গু নদীতে গিয়ে স্নান সেরে যা কিছু কুটিরে ছিল, তা দিয়েই পিণ্ড দিলেন।

পিতৃপুরুষগণ হাত বাড়িয়ে পিণ্ড গ্রহণ করলেন। তাঁদের মধ্যে দশরথও ছিলেন। দশরথ বললেন, "তোমার শ্রাদ্ধ সফল, আমরা পরিতৃপ্ত।" কিন্তু সীতার মনে একটু সন্দেহ রইল। শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আপনারা যে পরিতৃপ্ত হয়েছেন, হাত বাড়িয়ে পিণ্ড গ্রহণ করেছেন, সে কথা আপনার পুত্র বিশ্বাস করবে না।" দশরথ বললেন, "সাক্ষী রাখো।" সীতা বললেন, "ফল্গু নদী, এই ধেনু, অগ্নি আর কেতকী আমার সাক্ষী।"

এর কিছুক্ষণ পরই রাম এলেন, সঙ্গে লক্ষণ। এসেই বললেন, "শিগগির স্নান করে এসো! রান্না করতে হবে, শ্রাদ্ধের সময় চলে যাচ্ছে!" অথচ স্নানে যাবার কোনো তাড়া সীতার মধ্যে দেখা গেল না। রাম কিছুটা বিরক্ত হয়ে আবারও তাড়া দিলেন। এবার সীতা সব খুলে বললেন, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, এবং সেই পিণ্ড পিতৃপুরুষরা একেবারে হাতে হাতে গ্রহণ করেছেন।"

রাম সীতার কথা শুনে হেসে উঠলেন। পাশে দাঁড়ানো লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমরা শাস্ত্রমত ডেকেও ওঁদের দেখতে পাই না, আর উনি কোনো রকম ডাকতেই ওঁরা দেখা দিয়ে গেলেন! আসলে তোমার বৌদি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এবং ঘুমের মধ্যে ওই সমস্ত স্বপ্ন দেখছিলেন।" তারপর সীতার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তাই না! ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তাই তো!"

সীতার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল। রাম তাঁকে মিথ্যাবাদী ভাবছেন! তিনি রামকে বললেন, "রাঘব! আমি ঘুমাইনি, স্বপ্নও দেখিনি। আমি যা বলেছি, সবই সত্যি। আমিই পিণ্ডদান করেছি এবং তোমার পিতৃপুরুষরা সেটা গ্রহণ করেছেন। এই ফল্গু নদী, এই ধেনু, এই অগ্নি এবং এই কেতকী ফুল সবাই সাক্ষী।"

রাম তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই বলল, এ বিষয়ে কিছু জানেন না। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে—এই মিথ্যাচারটি কেন এই সাক্ষীরা করল? বিশেষত অগ্নি কেন এমন কাজ করতে গেল? এমন তো নয় যে সীতা তাঁদের মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলেছিলেন। এর কোনো উত্তর রামায়ণে পাওয়া যায় না। আমরা শুধু এটুকুই জানি, তাঁরা মিথ্যাচার করেছেন।

যাই হোক, রাম আর কথা বাড়ালেন না। সময় বয়ে যাচ্ছে। সীতা সব কিছু প্রস্তুত করে দিলেন। স্নান সেরে এসে রাম পিণ্ডদান করতে বসলেন। লক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। রাম পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। রামের আহ্বান শুনে দৈববাণী হলো, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, আমরা সীতার হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করেছি। তোমার পিণ্ডদান করার আর প্রয়োজন নেই।" রাম সেই কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি পিণ্ডদান করবেনই। এবার স্বয়ং সূর্যদেব বললেন, "রাঘব! আপনার শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, সীতা করেছেন।" এবার রাম-লক্ষণ কিছুটা লজ্জিত হলেন। সূর্যের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

যাই হোক, রাম আর কথা বাড়ালেন না। স্নান সেরে এসে রাম পিণ্ডদান করতে বসলেন। লক্ষণ তাঁকে অনুসরণ করলেন। রাম পিতৃগণকে আহ্বান করলেন। রামের আহ্বান শুনে দৈববাণী হলো, "পিণ্ডদান হয়ে গেছে, আমরা সীতার হাত থেকে পিণ্ড গ্রহণ করেছি। তোমার পিণ্ডদান করার আর প্রয়োজন নেই।" রাম সেই কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি পিণ্ডদান করবেনই। এবার স্বয়ং সূর্যদেব বললেন, "রাঘব! আপনার শ্রাদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, সীতা করেছেন।"

সূর্যদেবের সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। সীতা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেননি, উল্টো হাসাহাসি করেছেন। রাম-লক্ষণ কিছুটা লজ্জিত হলেন। তাঁদের উচিত ছিল দেবী জানকীকে বিশ্বাস করা। রামচন্দ্রের মনে একটা খটকা থেকেই গেল। কেতকী, ফল্গু, ধেনু এবং অগ্নি তো সাক্ষী ছিল। তাহলে মিথ্যে বলল কেন? লক্ষণও তাই ভাবছিলেন।

এমন সময় দুজনেরই কানে এলো সীতার কথা। সীতা বলছেন, "ফল্গু নদী, জেনেশুনে তুমি সত্য বলনি, তুমি পাতালে প্রবাহিত হও। অগ্নি, তুমি না দেবগণের মুখ! আজ থেকে তুমি সর্বভুক হবে। ধেনু, তুমি মুখে মিথ্যে বলেছ, আজ থেকে তুমি মুখে অশুচি, পবিত্র কেবল পুচ্ছদেশে। কেতকী, তুমি শিবের প্রিয় ছিলে, কিন্তু আর থাকবে না। তাঁর পূজায় তুমি অযোগ্য।"

কেতকী ফুল মহাদেব কতটা ভালোবাসতেন, কিংবা পূজার অযোগ্য হয়ে কেতকী ফুলের কতটা ক্ষতি হলো, তার চাইতেও বড় একটি প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এই গল্পের ফাঁকফোঁকরে। সেটা হলো—হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি প্রথা। এই গল্প থেকে জানা গেল, পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদানের অধিকার একচেটিয়াভাবে শুধু পুত্রদের নয়; কন্যা তো বটেই, এমনকি পুত্রবধূদের সেই অধিকার পুরোদমে আছে। নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, যা রামায়ণের যুগেও স্বীকৃত ছিল।

গল্পের ফাঁকফোঁকর : শকুনির প্রতিশোধ -
Guitar K Kanungo
Dec. 21, 2024 | category | views:109 | likes:17 | share: 6 | comments:0

মহাভারতের গল্পের কি শেষ আছে? যেন পেঁয়াজের খোসা! প্রতিটি খোসার নিচে অপেক্ষা করছে নতুন গল্প, নতুন রহস্য। প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে আছে চমকপ্রদ সব উপাখ্যান। শকুনির কথাই ধরা যাক ! কৌরবদের সেই কুখ্যাত মামা - বাসুদেব কৃষ্ণের পর মহাভারতের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটন পটিয়সী ! যদি শকুনি না থাকতো, দুর্যোধনের প্ররোচিত হত না, আর কোন প্রকার প্ররোচনা ছাড়া কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধ  কি হতে পারতো? 

এই শকুনিকে নিয়েও কিন্তু এক হৃদয় বিদারক কাহিনী আছে, যা শুনতে হলে ধীরে ধীরে সেই গল্পের গভীরে যেতে হবে। ফাঁকফোঁকরও চোখে পড়বে।  শকুনির জীবন এক করুন উপাখ্যান। একটি রাজ্যের রাজপুত্র হয়েও শেষ পর্যন্ত রাজ্যশাসন তার কখনোই করা হয়নি। আশ্রিত থেকেই তার জীবনের একটি বড় অংশ কেটে যাবে। 

গান্ধারীর গল্প আমরা সবাই জানি—অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তার বিয়ে এবং শতপুত্রের জননী হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এর পেছনে যে  আরও গভীর এক কাহিনী লুকিয়ে আছে ! গান্ধার, আজকের কান্দাহার, আফগানিস্তানের ছোট্ট রাজ্য, যেখানে রাজা সুবল শাসন করতেন। একদিন, পরাক্রমশালী রাজ্য হস্তিনাপুরের দেবব্রত ভীষ্ম এসে সুবলের কাছে তাঁর ভ্রাতৃষ্পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের জন্য গান্ধারীর বিয়ের প্রস্তাব দেন। সুবল মনে মনে অস্বীকৃত হলেও, ভীষ্মের শক্তি ও হস্তিনাপুরের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে বাধ্য হয়ে এই প্রস্তাবে রাজী হন। গান্ধারীকেও রাজী হতে হয়। 

এরপর, ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী সুখে বসবাস করতে থাকেন - গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। সেটা হলে আমাদের দ্বিতীয় গল্পে প্রবেশ করা হত না। গান্ধারীর রাশিফলে বলা ছিল যে তাঁর প্রথম স্বামী বিবাহের পরপরই মারা যাবেন। এই ভবিষ্যদ্বাণী এড়ানোর জন্য গান্ধারীর ছোটবেলায় একটি ছাগলের সঙ্গে তাঁর প্রতীকী বিবাহ সম্পন্ন করা হয়েছিল। এই ঘটনা জানাজানি হলে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন; তিনি নিজেকে প্রতারিত মনে করেন, যদিও তাঁর প্রতারিত বোধ  করার বিশেষ কোন কারণ ছিল না। এমন ঘটনা কেবল প্রাচীন যুগে নয়, পঞ্চাশ বছর আগেও উপমহাদেশের অনেক স্থানে ঘটেছে। এই অবস্থায় ভীষ্ম কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না, এমন তো হতে পারে না ! এর পরে যা ঘটবে সেটাই আমাদের তৃতীয় গল্প।  

তবে গল্পে ঢোকার আগে একটা কথা বলে নিতে হয়। যদি ভীষ্ম সেই সিদ্ধান্ত না নিতেন, তাহলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হত না ! যাই হোক, আসল ঘটনায় ফিরে আসি। ভীষ্ম, রাজা সুবল ও শকুনি সহ গান্ধারীর সব আত্মীয়কে হস্তিনাপুরে ডেকে আনেন। ক্ষমতাবান আত্মীয়ের এই আমন্ত্রণ এড়াতে পারলেন না রাজা সুবল, সবাই এলেন হস্তিনাপুরে। এরপরেই ঘটল ভয়ানক ঘটনাটা ! ভীষ্ম এদের সবাইকে সরাসরি কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন ! এদের মধ্যে রাজা সুবল এবং রাজকুমার শকুনিও ছিলেন। 

ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে এইরকম নিষ্ঠুর একটা আদেশ কাযর্কর হবার আগে কিংবা পরে গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল, সেটা অবশ্য পরিষ্কার জানা যায় না। একটা  সম্ভাবনা হতে পারে যে গান্ধারী এই ঘটনার কিছুই জানতেন না। যদি জানতেন, হয়তো সে সময় তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করতেন। গান্ধারীর ছাগলের সঙ্গে বিয়ের গল্প এবং সেই ঘটনার গোপন রাখা—এটা দেখে ভীষ্মের ক্রুদ্ধ হবার সঙ্গত কোন কারণ নেই। ভীষ্ম আগেই জানতেন যে রাজা সুবল গান্ধারীর বিয়েতে রাজী ছিলেন না; বিশেষ করে শকুনির কাছ থেকে তিনি হয়ত বিপদের আশংকা করেছিলেন। আমার ধারণা, ভীষ্ম গান্ধার রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে হস্তিনাপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে, এটি কোনো ফলপ্রসূ পদক্ষেপ ছিল না। বরং, এর মাধ্যমে তিনি এক রক্তাক্ত ভবিষ্যতের পটভূমি নির্মাণ করেছিলেন।

কুটুম্ব বাড়ির সবাইকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, এইটুকু মেনে নেওয়া গেলেও, পরবর্তীতে ভীষ্মের তরফ থেকে যে সিদ্ধান্ত এলো, সেটা রীতিমত নৃসংশ। ভীষ্ম কেন এইরকম একটা কাজ করতে গেলেন, তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কারাগারে গান্ধার থেকে যারা এসেছেন, তাদের একসাথে রাখা হত এবং সবার জন্য মাত্র এক মুষ্ঠি চাল বরাদ্দ দেয়া হত, যা দিয়ে কেবল একজন মানুষের উদরপূর্তি করা যেত। ফলস্বরূপ, একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হল এক মুষ্ঠি চাল দিয়ে সবার পক্ষে জীবন ধারণ সম্ভব নয়, তাহলে অন্তত একজন বেঁচে থাকুক। শকুনিকেই সেই একজন হিসাবে নির্বাচিত করা হল, এবং শেষ পর্যন্ত শকুনিই বেঁচে রইলেন।

রাজা সুবল মারা যাবার আগে শকুনি বলে গেলেন, তাঁর অস্থি দিয়ে শকুনি যেন পাশা খেলার গুটি বানিয়ে নেয়, যে গুটি সবসময় শকুনির ইচ্ছে মাফিক দান ফেলবে। এখন সুবলের অস্থি দিয়ে গুটি বানালেই যে সেই গুটি শকুনির ইচ্ছে মাফিক দান ফেলবে, এই ব্যাপারটাকে যদি আমরা কষ্টকল্পনা বলেও বিবেচনা করি, এমন তো হতে পারে যে কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শকুনি আসলে এই পাশা খেলাটা এমনভাবে রপ্ত করছে যে অন্য কারো পক্ষেই তাকে হারানো নিতান্তই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল এবং আমার ধারণা, পাশা খেলার এই দক্ষতাটা সে তার পিতা রাজা সুবলের কাছ থেকেই শিখেছিল। রাজা সুবলের  অস্থি দিয়ে পাশার গুটি বানানোর কথা বলে আসলে এই ব্যাপারটাকেই হয়ত বোঝানো হয়েছে। 

এর পরের ঘটনা আমাদের অনেকেরই জানা। গান্ধারী হস্তক্ষেপে শকুনি মুক্তি পেলেন, কিন্তু যে শকুনি মুক্তি পেলেন, তিনি আর সেই আগের শকুনি নেই। তিনি তাঁর পিতার, তাঁর পরিবারের, তাঁর বোনের অবমাননাকর পরিস্থিতির বদলা নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এই প্রতিজ্ঞা থেকে আমৃত্যু এক বিন্দু বিচ্যুত হননি। গান্ধারী কুরুবংশ ধ্বংসের জন্যে কৃষ্ণকে অভিসম্পাত দিলেই, এই বংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পেছনে শকুনির অবদানও খুব একটা কম ছিল না। পাশা খেলায় হারিয়ে পান্ডবদের বনবাসে পাঠানো থেকে শুরু করে, ভীমকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা থেকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, যে যে ঘটনাগুলো কুরুবংশের ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছিল, এই প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে শকুনির প্ররোচনা ছিল। দুর্যোধন শকুনির হাতের একটা পাপেট ছিল মাত্র।

তবে সবচাইতে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে শকুনিকে আমরা সাধারণ পাঠকেরা এত অপছন্দ করি, সেই শকুনি কিন্তু ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের আগেই স্বর্গে পৌঁছে গেছিলেন। তার বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছিল, সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে তাঁর গীতা শোনার প্রয়োজন হয়নি। তার মধ্যে অর্জুনের মত কোন ধর্মসঙ্কট ছিল না। তিনি তাঁর লক্ষ অর্জনে এতটাই অবিচল এবং আন্তরিক ছিলেন যে তাঁকে স্বর্গে ঠাই না দিয়ে ঈশ্বরের অন্য কোন উপায় ছিল না।


গল্পের ফাঁকফোঁকর: সদ্যজাত কৃষ্ণের যমুনা অতিক্রম। -
Guitar K Kanungo
Dec. 20, 2024 | category | views:69 | likes:16 | share: 3 | comments:0

বাসুদেব কৃষ্ণ হিন্দুদের পরম আরাধ্য। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। বলা হয়, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য তাঁর এই অবতীর্ণ হওয়া। শ্রাবণ মাসের অষ্টমী তিথিতে এক প্রবল বর্ষণের রাতে তাঁর জন্ম হয়েছিল মথুরার এক কারাগারে। তাঁর জন্মের কয়েক বছর আগে দৈববাণী হয়েছিল, তাঁর মায়ের অষ্টম সন্তানের হাতে সেই সময়কার মথুরার দুরাচারী রাজা কংসের মৃত্যু হবে। ফলত তাঁর জনক বসুদেব এবং জননী দেবকীকে কারারুদ্ধ করা হয়, এবং কৃষ্ণের জন্মের আগেই এই দম্পতির যেসব সন্তান জন্মেছিল, তাদের সবাইকে দুরাচারী কংস জন্মের পরপরই হত্যা করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি কংস দেবকী এবং বসুদেবের এতগুলো সন্তানকে হত্যা করেছিল? এই দৈববাণী যখন হয়েছিল, তখন দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়েটা সবেমাত্র সম্পন্ন হয়েছে। এই সময় দেবকী অথবা বসুদেব, দুজনের একজনকে হত্যা করলেই এই দৈববাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করা যেত। কেউ কেউ বলবে দেবকী উগ্রসেনের কন্যা; কংস ইতোমধ্যে উগ্রসেনকে সরিয়ে মথুরার রাজা হয়ে বসেছে এবং সম্পর্কে দেবকী কংসের বোন - এরকম অবস্থায় দেবকীকে হত্যা করা বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। একই কথা বসুদেবের ক্ষেত্রেও খাটে; বসুদেব ছিলেন সংঘমুখ্যদের একজন, তাঁকে হত্যা করাটাও সহজ ছিল না।

ভালো কথা, কিন্তু এদের দুজন অথবা দুজনের যেকোনো একজনকে হত্যা করার মধ্যে ঝুঁকি ছিল। তবে এদের দুজনের কাউকে হত্যা না করেও কংস তাঁর জীবনের উপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, সেটা 'নিউট্রালাইজ' করতে পারতেন। বসুদেবকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেই সমস্ত ল্যাঠা চুকে যেত। দেবকীর গর্ভধারণের সুযোগ তৈরি না হলেই তো কংসের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তিনি এই সহজ কাজটা না করে যে কাজটা করলেন, তাতে কংস নিজেই নিজের মৃত্যু একপ্রকার নিশ্চিত করলেন। তিনি দুজনকেই কারারুদ্ধ করলেন। শুধু তাই নয়, দুজনকে একই সঙ্গে বসবাস করতে দিলেন। দেবকী একের পর এক গর্ভধারণ করলেন এবং কংস শিশু হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করে গেল বছরের পর বছর।

এই বুদ্ধিটা কংসের মাথায় কেন এলো না, সেটা কংসই ভালো বলতে পারবেন। এদিকে যথাসময়ে দেবকী গর্ভধারণ করলেন। কৃষ্ণের জন্ম হলো; আগেই বলেছি, তিনি ভগবান বিষ্ণুর অবতার। কংসের হাতে মরবার জন্যে তিনি জন্মাননি, কংসকে হত্যা করবার জন্যেই তিনি জন্মেছেন। নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করলেন। কারারক্ষীদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই ফাঁকে পিতা বসুদেব নবজাত কৃষ্ণকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তাঁকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসার জন্য যাতে পরদিন সকালে এসে কংস এই সন্তানকেও হত্যা করতে না পারে। বসুদেব ঝড়ের রাতে যমুনা নদী পেরিয়ে ওপারের বৃন্দাবনে পৌঁছালেন, যেখানে তাঁর বন্ধু নন্দরাজ থাকতেন।

বৃন্দাবন যাবার পথে বেশ কিছু ঘটনা ঘটবে। বর্ষা মৌসুম থাকার কারণে যমুনার জল অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বসুদেবের পক্ষে হেঁটে যমুনা পার হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু যমুনার জলে কৃষ্ণের পায়ের ছোঁয়া লাগতেই যমুনার জল অনেকটাই কমে গেল। এতটাই কমে গেল যে এবার বসুদেব পায়ে হেঁটে পার হতে পারছিলেন। কিন্তু সমস্যা আরও ছিল। প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছিল। একটি ঝাঁকার মধ্যে সদ্যজাত শিশু কৃষ্ণকে বৃষ্টির প্রকোপ থেকে রক্ষা করার জন্য এবার নাগরাজ বাসুকী এগিয়ে এলেন। তিনি পেছন থেকে ফণা তুলে ধরলেন যাতে কৃষ্ণের গায়ে জলের ছিটা না লাগে। ধর্মপ্রাণ মানুষদের এইসব ঘটনা বড় ভালো লাগে। এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছিল কিনা, ঘটার কোনো সম্ভাবনা ছিল কিনা, সেসব নিয়ে তারা ভাবতে রাজি নয়। তারা বিশ্বাস করে এরকমটাই ঘটেছিল।

অনেকেই বিশ্বাস করেন বাসুদেব কৃষ্ণ কেবলমাত্র একটা পৌরাণিক চরিত্র নয় ; তিনি সত্যিই জন্মেছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষ্ণকে যদি যেভাবে বিশ্বাস করা হয়, অর্থাৎ একজন অবতার হিসাবে দেখি তাহলে যে ঘটনাগুলোর কথা বলা হল সেসব ঘটতেই পারে। কিন্তু যদি তিনি একজন সাধারণ মানুষ হয়ে থাকেন, তাহলে তো যমুনার পানি কমে যাওয়া কিংবা বাসুকীর বৃষ্টির ছাট থেকে সদ্যজাত কৃষ্ণকে রক্ষা করা, এসব অলৌকিক ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। সঙ্গত কারণেই যুক্তিবাদী মানুষ অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেনা। তারা যমুনা পারাপার করার সময় এই ঘটনাগুলো আদৈ ঘটেছে সেটা নিয়ে সন্দেহ প্ৰকাশ করে। 

সবচাইতে বিস্ময়কর যে কথাটা তারা বলছে, সেটা হলো বসুদেবকে আসলে যমুনা নদী পারাপার করতেই হয়নি, কারণ মথুরা থেকে বৃন্দাবন যেতে যমুনা পারাপার করতে হয় না। বৃন্দাবন আসলে যমুনার এইপাড়ে, যে পাড়ে মথুরা অবস্থিত। বসুদেব হয়তো কিছুটা পথ যমুনার পাড়ের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে নদী পার হয়ে অন্য পারে যেতে হয়নি। এই তথ্যটা হজম করা আমার জন্য বেশ কঠিন কাজ ছিল, কারণ যমুনার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের একটা গভীর সম্পর্ক বজায় থাকবে, অন্তত যতদিন তিনি বৃন্দাবনে ছিলেন, এবং সেই সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল তাঁর জন্মের ঠিক পর থেকেই। অথচ এখন শুনছি বসুদেবকে যমুনা পাড়ি দিতেই হয়নি।

এখন চাইলেই গুগল ম্যাপ খুলে এই জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কোন পথে যেতে হবে এবং যেতে কতটা সময় লাগবে, সেটা ঝট করে দেখে নেওয়া যায়। আমিও তাই করলাম। গুগল ম্যাপ মথুরা থেকে বৃন্দাবন যাবার দুটো রাস্তার কথা বলছে, কিন্তু এর কোনটাই যমুনা নদীকে অতিক্রম করে নয়। আমি গল্পের ফাঁকফোঁকর খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, দেখলাম এক বিশাল গহ্বর আবিষ্কার করে বসে আছি।

গল্পের ফাঁকফোঁকর: মাতৃজঠর ছাড়াই সন্তানের জন্ম। -
Guitar K Kanungo
Dec. 19, 2024 | category | views:287 | likes:4 | share: 2 | comments:0

জৈবিকভাবে দেখতে গেলে মাতৃজঠর ছাড়াই সন্তানের জন্ম হওয়ার উপায় নেই। এমনকি যাদেরকে 'টেস্টটিউব' বেবি নামে ডাকা হয়, তাদেরও জন্ম হয় শেষ পর্যন্ত মাতৃজঠরেই। পৃথিবীতে অবতার কিংবা মেসাইয়াদের জন্মকে অলৌকিক করে তোলার একটা প্রবণতা প্রায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই আছে, কিন্তু যীশু বলি আর কৃষ্ণ, এরা কেউই মাতৃজঠর এড়িয়ে জন্মাতে পারেননি।

কিন্তু পুরাণগুলিতে মাতৃজঠর এড়িয়ে সন্তান জন্ম দেবার বেশ কিছু ঘটনার কথা বলা আছে। এইসব গল্পের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত গল্পটি গ্রীক পুরাণে বলা হয়েছে—জ্ঞানের দেবী এথেনার জন্ম নিয়ে। এথেনা বারোজন অলিম্পিয়ান দেব-দেবীর মধ্যে অন্যতম এবং তিনি দেবরাজ জিউসের কন্যা। মজার ব্যাপার হলো, তিনি কোনো মাতৃজঠরে জন্মাননি। তিনি জিউসের মাথা ফেটে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। কেন এরকম হয়েছিল সেই গল্পটা বেশ মজার—এবার সেটা বলি; ফাঁকফোঁকরের আলোচনাটা একটু পরে হবে।

হেরা নয়, জিউসের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল মেটিস। দৈববাণী হয়েছিল মেটিসের গর্ভজাত সন্তানের হাতে জিউস ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। এই দৈববাণী শুনে জিউস ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ছল করে মেটিসকে আকারে ছোট হয়ে যেতে বললেন। মেটিস সেটা হতেই জিউস তাকে চট করে গিলে ফেললেন। কিন্তু গিলে ফেললে কী হবে, মেটিস সেই সময় গর্ভবতী ছিলেন। এদিকে মেটিসকে গিলে ফেলার পর থেকেই জিউসের প্রবল মাথাব্যথা হতে থাকল। এই মাথাব্যথা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আরেক অলিম্পিয়ান দেবতা হেফাস্টাস জিউসের মাথায় কুড়াল দিয়ে আঘাত করেন। সেই আঘাতের ফলে জিউসের মাথার খুলি ফেটে সেখান থেকে এথেনা বেরিয়ে আসেন—পূর্ণবয়স্ক অবস্থায়, কবচ-কুন্ডল পরে থাকা অবস্থায়।

তবে এথেনার চেয়ে গ্রীক দেবী আফ্রোদিতির জন্মকাহিনী আরো অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক, অনেক বেশি প্রশ্নের জন্ম দেবে। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, ক্রোনাস তার স্বৈরচারী পিতা ইউরেনাসের জননেন্দ্রিয় কেটে সেটা সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সেই জননেন্দ্রিয় গিয়ে সমুদ্রের পুঞ্জীভূত ফেনার উপরে পড়ে এবং সেখান থেকে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির জন্ম হয়।

গোটা ব্যাপারটাকে কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু এই অস্বাভাবিক ঘটনাকেও ব্যাখ্যা করা যায় যদি এই গোটা ব্যাপারটাকে একটি 'মেটাফর' হিসাবে দেখা যায়। এথেনার এইভাবে জন্মানোটা আসলে প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধির আবির্ভাবের প্রতীক। গ্রীকরা বোঝাতে চায়, প্রজ্ঞা এবং বুদ্ধি আবশ্যিকভাবে মনসিজ, কোনো প্রকারের জৈবিক প্রজননের মাধ্যমে এর সৃষ্টি করা চলে না। এইটুকু না হয় মেনে নেওয়া গেল, ধরেই নিলাম এটা আসলে একটা মেটাফর; কিন্তু যখন বলা হয়, কামাতুর কোনো এক দেবতার বীর্যস্খলনের ফলে নির্গত বীর্য থেকে সন্তানের জন্ম হচ্ছে—সেটাকে কল্পবিজ্ঞান নাম দিয়ে, কিংবা সেটাকেও কোনো একটা মেটাফর হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এরকম ঘটনা হিন্দু এবং গ্রীক পুরাণে অজস্র পরিমাণেই আছে।

আচার্য দ্রোণের জন্মের কথাই ধরা যাক। একদিন মহর্ষি ভরদ্বাজ গঙ্গা নদীতে প্রাত্যহিক আচার সম্পন্ন করছিলেন। এমন সময় তিনি ঘৃতাচী নামের এক অপ্সরাকে দেখতে পান। অপ্সরারা যৌনাবেদনময়ী হয়ে থাকেন, তাঁদের শরীরে কাপড়চোপড়ও বিশেষ কিছু থাকে না, আর থাকলেও সেগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে সেগুলো থাকা না থাকা বিশেষ কোনো পার্থক্য তৈরি করে না। ফলে মহর্ষি ভরদ্বাজ কামাতুর হয়ে পড়লেন। কামাতুর হয়ে পড়লেও তিনি একজন সাধক পুরুষ, একজন ঋষি; রিপুকে বশে রাখাই তাঁর কাজ। তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। তাঁর বীর্যস্খলন হয়ে গেছে এবং স্খলিত বীর্য গিয়ে পড়ল এক পাত্রে। কালক্রমে সেই পাত্রে এক শিশুর জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয়েছিল দ্রোণ। ইনি পরবর্তীতে দ্রোণাচার্য নামে খ্যাত হবেন।

একটি শিশু জন্মানোর জন্য অসংখ্য শুক্রাণুর পাশাপাশি কিছু ডিম্বাণুরও প্রয়োজন। সেই ডিম্বাণু কোথা থেকে এলো, একটা এম্ব্রায়ো কীভাবে সৃষ্টি হলো—যা কিনা পরবর্তীতে একটা পূর্ণ মানবশিশুতে রূপান্তরিত হয়—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মজার ব্যাপার হলো, এই রকম ঘটনা মহাভারতে কেবল দ্রোণাচার্যের ক্ষেত্রে হয়েছে তা নয়; মহাভারতের যুযুধান কুরু-পাণ্ডবদের পিতামহী সত্যবতীর জন্মও খুব একটা কম রহস্যজনক নয়। সেই গল্পটা বলার আগে গ্রীক দেবী এথেনাকে ঘিরে এই রকম স্খলনজনিত ঘটনার কথা বলা আছে, সেটা আগে বলি, তারপর মৎসগন্ধার গল্পে ফিরব।

এথেনার কথা আগেই বলেছি—গ্রীকদের জ্ঞানের দেবী। সম্পর্ক স্থাপনে ইনি খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু তিনি আগ্রহী না হলে অন্য দেবতারা আগ্রহী হবেন না, এমন তো কোনো কথা নেই। একদিন হেফাস্টাস এথেনাকে 'সেডিউস' করার চেষ্টা করেন। কাম নামের রিপুটা এথেনার মধ্যে একেবারেই ছিল না। তিনি ছিটকে সরে যান হেফাস্টাসের কাছ থেকে। মহাভারতে ঋষি ভরদ্বাজের যে অবস্থা হয়েছিল, হেফাস্টাসের ক্ষেত্রেও তা হলো। কিন্তু স্খলিত বীর্য কোনো পাত্রে গিয়ে পড়ল না। গিয়ে পড়ল বসুন্ধরার গায়ে। গ্রীকরা ধরণীকে গাইয়া নামে জানে। হেফাস্টাসের বীর্য ধারণ করে গাইয়া গর্ভবতী হলেন। জন্ম হলো সন্তানের, যিনি কিনা পরবর্তীতে এথেন্সের রাজা হবেন, যে এথেন্স শহরটি এথেনার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল।

এবার মহাভারতের ঘটনায় ফেরা যাক। উপরিচর বসু নামের একজন খুব বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তিনি মৃগয়া করতে গিয়েছিলেন। আগেকার দিনের রাজার মৃগয়া করতে গেলেও সঙ্গে পত্নী, উপপত্নীদের নিয়ে যেতেন। কিন্তু উপরিচর বসু একাই বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিন না যেতেই স্ত্রী গিরিকার শারীরিক বিরহে খুবই কাতর হয়ে পড়লেন। এরকম অবস্থায় অন্য সবার ক্ষেত্রে যা হয়, উপরিচর বসুর ক্ষেত্রেও তা হলো। তিনি তাঁর স্খলিত বীর্য একটি পাতায় মুড়িয়ে সেটাকে সেটি এক ঈগলকে দিয়ে রাজধানীতে পাঠিয়ে দিলেন, যাতে তাঁর স্ত্রী গিরিকা সেটি ধারণ করে গর্ভধারণ করতে পারেন। ঈগলটি উড়ে যাবার সময় আরেকটি ঈগল দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে ঈগলটি যে বস্তুটা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা এক নদীতে গিয়ে পড়ে। একটি মাছ তাতে গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে একটা ছেলে এবং একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। এই কন্যা সন্তানটিই মৎসগন্ধা, যার সঙ্গে পরবর্তীতে হস্তিনাপুরের মহারাজা শান্তনুর বিয়ে হয়েছিল।

শুরুতেই বলেছিলাম গল্পের ফাঁকফোঁকর খুঁজে বের করব। কিন্তু এক মাটির পাত্রে দ্রোণাচার্যের জন্ম হওয়া, কিংবা জিউসের মাথা থেকে এথেনার এবং উরু থেকে ডায়োনিসাসের জন্ম হওয়া—এইসব পৌরাণিক গল্পের কোথায় কোথায় ফাঁকফোঁকর আছে, সেটা বোধ হয় আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মিথ গল্প হলেও সেইসব গল্পে সময়ের ইতিহাস এবং ভাবনা ইত্যাদি মিশে থাকে। কল্পবিজ্ঞানের মতো যারা পুরাণ রচনা করেন, তারা আগামীকালকে বর্তমানে ধরতে চান। মহাভারতের ঘটনাগুলিতে বিবাহবহির্ভূত যৌনতার বিষয়টাই প্রধানত এসেছে।

ভরদ্বাজের কথাই ধরা যাক। অনেক দিন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের পর গঙ্গাতীরে এক সুন্দরী রমণীকে দেখে তিনি কামাতুর হতেই পারেন, তিনি সেই নারীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে যেতেই পারেন। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে এইভাবে স্বীকার করে নিলে মহর্ষি ভরদ্বাজের মহত্ব বজায় থাকে না। তাই স্খলন, পাত্র এবং দ্রোণের জন্ম ইত্যাদি কল্পনা করতে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যে নারীকে ঘৃতাচী নামে ডাকা হচ্ছে, তিনিই দ্রোণের সত্যিকারের জননী। কুন্তীর মতো কুমারী মাতা বলেই হয়তো সন্তান জন্মদানের কথা প্রকাশ্যে বলতে পারেননি। মাতৃজঠর এড়িয়ে যে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায় না, সেটা প্রাচীন ভারতীয়রা ভালোই জানতেন।

তবে গ্রীকদের যৌনতা বিষয়ক ধ্যান-ধারণা ভারতীয়দের মতো ততটা রক্ষণশীল ছিল না, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক ছিল পুরো মাত্রাতেই। সেইজন্যেই জিউসের উদ্দাম, অনিয়ন্ত্রিত যৌনতা নিয়ে ঈর্ষাকাতর হতে দেখা যায় হেরাকে। তাতে অবশ্য জিউসকে দমিয়ে রাখা যায়নি; তিনি তাঁর কমর্কান্ড চালিয়ে গেছেন পুরোদমে। হেরার ক্রোধের শিকার হয়েছেন সেইসব নারী যারা জিউসের লালসার শিকার হয়েছেন। এই ব্যাপারটিকে নৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে, অবিচারই বলা চলে। মজার বিষয় হচ্ছে জিউস বৈবাহিক সম্পর্কের পবিত্রতা বজায় না রাখলেও হেরা কিন্তু সেই কাজটা করে গেছেন গভীর নিষ্ঠার সাথে; তিনি কখনোই বিবাহ বহির্ভুত কোন সম্পর্কে জড়াননি।    

গল্পের ফাঁকফোঁকর : যুধিষ্ঠিরের ধর্মাচরণ -
Guitar K Kanungo
Dec. 18, 2024 | গল্প | views:149 | likes:10 | share: 2 | comments:0

যুধিষ্ঠির মহাভারতের নায়ক, যেখানে দুর্যোধন প্রতিনায়ক – সাধারণভাবে এভাবেই দেখা হয়, যদিও আমি মনে করি ঘটোৎকচপুত্র বর্বরিকের কথাটাই যথার্থ। মহাভারতের আসল নায়ক বাসুদেব কৃষ্ণ; যুধিষ্ঠির তো নন, এমনকি অর্জুনও নন, যদি বীরত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। হোমারের ইলিয়াড-এ আকিলিসই নায়ক —সন্দেহাতীতভাবে। ইলিয়াড শুরুই হয়েছে আকিলিসের ক্রোধের বর্ণনা দিয়ে। কিন্তু মহাভারতে বাসুদেব কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটবে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভার পূর্বাহ্নে। এরপর সমগ্র মহাভারতে যা ঘটেছে, সবকিছুতেই তিনি আছেন, পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে।   

তবে আমাদের প্রথা মেনে চলতে হবে। সেই প্রথা অনুযায়ী, যুধিষ্ঠিরই নায়ক। এই যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র হিসাবে পরিচিত, যদিও আমার ধারণা আসলে ইনিই বিদুরের ঔরসজাত। যেহেতু তিনি ধর্মপুত্র, অধর্মের কোনো কাজ তিনি করতে পারেন না। ধর্মপ্রাণ পাঠকেরা সেভাবেই দেখবেন। আসলে, এইভাবে দেখার ব্যাপারটা পাঠক হিসাবে আমাদের একটা সমস্যা — আমরা অনেকেই পূর্বধারণা নিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। যুধিষ্ঠির তেমনই একটি চরিত্র। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সীতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়েছিলেন এবং প্রজাদের সমালোচনার মুখে সীতাকে আবারো বনবাসে প্রেরণ করার কাৰণে রামচন্দ্রকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। রামকে কখনো কখনো একজন 'মিসোজিনিস্ট' হিসাবে চিত্রিত করার প্রবণতা আছে আমাদের মধ্যে  ; কিন্তু সেটা করতে গিয়ে রাম যে সীতা ছাড়া অন্য কারো প্রতি আকৃষ্ট হননি, অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে একপত্নীব্রত ছিলেন, সেই ব্যাপারটা উপেক্ষা করা হয়েছে। যদি তিনি সীতাকে ভালো নাই বাসবেন তাহলে তিনি একপত্নীব্রত থাকতে গেলেন কেন ?  

ধর্মপুত্র হিসেবে পরিচিতি পেলেও এবং যকের প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারে সেই পরিচিতি সবার কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেও গোটা মহাভারত জুড়ে যুধিষ্ঠির এমন কিছু কাজ করেছেন, যা গুরুতর প্রশ্নের উদ্রেক করে। দ্রোণাচার্যের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলা—অর্ধসত্য মিথ্যা, যা আসলে মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর—এদের মধ্যে একটি। পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরা আরেকটি, এবং যুধিষ্ঠিরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দ্রৌপদী যে আইনগত 'আর্গুমেন্ট' তুলেছিলেন, আজকের দিনে এটি হলে হয়তো সুপ্রিম কোর্টের 'রেফারেন্স' হয়ে যেত। রাজ্য হারানোর পাশাপাশি যুধিষ্ঠিরের জেল-জরিমানা পর্যন্ত হতে পারত। কোনো অর্থেই এটি যুধিষ্ঠিরের পক্ষে সদাচার ছিল না।

যুধিষ্ঠিরের এই আচরণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে—পক্ষে-বিপক্ষে; যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপক্ষে। এই একই জুয়ার আসরে তিনি আরও একটি অধর্মের কাজ করেছেন, যা অনেকের চোখে ঠিকঠাক ধরা পড়ে না। এই কাজটা তিনি করেছিলেন নকুল ও সহদেবকে নিয়ে। নকুল ও সহদেব অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের পুত্র কিনা—সেই আলোচনা এখানে করতে চাই না—কিন্তু তারা মাদ্রীর গর্ভজাত, কুন্তীর গর্ভজাত নয় একথা সত্য । সেই হিসাবে, এই দুই ভাই যুধিষ্ঠিরের সহোদর নয়। এই জন্যেই কি যুধিষ্ঠির ভাইদের বাজি ধরার সময় প্রথমেই নকুল ও সহদেবকে বাজি ধরেছিলেন? সৎ ভাই ছিলেন বলেই কি ? তিনি যদি অর্জুন কিংবা ভীমের মধ্যে একজনকে সবার আগে বাজি ধরতেন, তাহলে সেটিই ধর্মের কাজ হত।

দ্রৌপদীকে অর্জুন জয় করেছিলেন, এবং দ্রৌপদী নিজেও মনে-প্রাণে অর্জুনকেই কামনা করছিলেন। পারিবারিকভাবেই তাঁর মধ্যে এই অনুভূতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছিল। নইলে তিনি বিনা দ্বিধায় কর্ণকেই বরং বরন করতে পারতেন। রূপে, গুণে, বীরত্বে কর্ণ কোনো অংশে অর্জুনের তুলনায় খাটো ছিলেন না—স্বর্গীয় কবচ ও কুন্ডল নিয়েই যাঁর জন্ম। স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে কর্ণই একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন।  রূপবান তো ছিলেনই, কেবল শিক্ষাকেই যদি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়, তাহলে অর্জুন ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, যেখানে কর্ণ হার্ভার্ড থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে এসেছেন। মহাভারত-এর রথী-মহারথীদের মধ্যে কেবল দুজনের এই শিক্ষাগত পটভূমি ছিল: দেবব্রত ভীষ্ম এবং আচার্য দ্রোণ; এঁরা দুজনই কর্ণের মতো ভার্গব পরশুরামের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় পরশুরামের আশ্রমটাই ছিল সেই সময়কার হার্ভাড কিংবা স্ট্যানফোর্ড যেহেতু সর্বকালের সর্বশ্রষ্ঠ অস্ত্রবিদ স্বয়ং পরশুরাম ছিলেন সে আশ্রমের আচার্য। 

দ্রৌপদী এমন একজন কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন অর্জুনকে পাওয়ার জন্য, কিন্তু সেই অর্জুনকেও তাঁর পাওয়া হয়নি যুধিষ্ঠিরের লালসার কারণে। যুধিষ্ঠির নিজের অর্জিত নয় জেনেও দ্রৌপদীকে ভোগ করেছিলেন; নিজের অধিকার নেই জেনেও, পাশা খেলায় হেরে যাবেন জেনেও, দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন। শুধু তাই নয়, অদ্ভুদ এক নিয়ম চালু করেছিলেন যুধিষ্ঠির এবং সেই নিয়মের ফাঁদে ফেলে অর্জুন যাতে অচিরে দ্রৌপদীর সঙ্গে মিলিত হতে না পারে সেই  ব্যবস্থাকেও পাকাপোক্ত করেছিলেন অর্জুনকে এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে। অর্জুনের অপরাধ তিনি কামাতুর হয়ে পড়েছেন এবং তাঁর চারিত্রিক শুদ্ধতা ফিরে পাবার জন্য অন্ততপক্ষে এক বছরের জন্য নির্বাসনে যাবার প্রয়োজন।  কিন্তু অর্জুন যে কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন সেটা ছিল অস্ত্রাগার ; সেখানে যুধিষ্ঠির দিনে দুপুরে দ্রৌপদীকে নিয়ে যা করছিলেন সেটাকেও যে  কামাতুরতা বলে চলে সে প্রশ্ন কেউ তুলল না।   

ভাগ্যিস! অর্জুন একিলিস ছিলেন না। একিলিস তাঁর প্রেয়সী ব্রিসেইসের জন্যে গ্রীকবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আগামেমননের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন; তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন এবং ট্রোজানদের সঙ্গে গ্রীকদের যে যুদ্ধ চলছিল, সেই যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলত, আগামেমনন ব্রিসেইসকে একিলিসের কাছে ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্জুন এসবের কিছুই করেননি। তিনি অগ্রজের আদেশ মেনে নির্বাসনে চলে গিয়েছিলেন। অগ্রজের আদেশ মান্য করা ধর্ম; অর্জুন সেটা করেছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কি ধর্মাচরণ করেছেন?

গল্পের ফাঁকফোঁকর : দুই -
Guitar K Kanungo
Dec. 16, 2024 | গল্প | views:125 | likes:3 | share: 2 | comments:0

পুরু আর আলেকজান্ডার। মহাবীর আলেকজান্ডারের কথা কে না জানে? জানা পৃথিবীর অনেকটাই জয় করে ফেলেছিলেন এই যুবক। অনেকেই বলেন, হোমারের নায়ক একিলিসের ঐতিহাসিক সংস্করণ ছিলেন তিনি। অন্যদিকে, পুরু আমাদেরই একজন, পৌরব নামের এক রাজ্যের রাজা। এই প্রাচীন ভারতীয় রাজ্যটি ঝিলাম ও চেনাব নদীদ্বয়ের মধ্যেভাগে অবস্থিত ছিল, যা আধুনিক পাঞ্জাব এবং বিপাশা নদীর অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত।


৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের সাথে বিতস্তার তীরে পুরুর প্রথম দেখা হয়। দেখা হয় বলতে, আসলে দুই পক্ষের সেনাবাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয় লড়াই করবার জন্য। আলেকজান্ডার ভারতের কথা শুনেছেন; তিনি এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে ভারত দখলে নিতে চান। রাজা পুরু তাঁর গতিপথ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে যান। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত দুর্দমনীয় গ্ৰীক বাহিনীর কাছে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান। পুরুকে গ্রেফতার করে আলেকজান্ডারের সামনে হাজির করা হয়।

এখানে একটা কথা বলে নেয়া দরকার, আলেকজান্ডার বয়সে তরুণ হলেও অত্যন্ত সুশিক্ষিত একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর পিতা মেসেডোনিয়ার রাজা ফিলিপ সেই সময়ের পৃথিবীর সবচাইতে শ্রেষ্ঠতম শিক্ষকের দ্বারা পুত্রের শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেছিলেন। মহাজ্ঞানীদের শিক্ষক নাম খ্যাত এরিস্টটল ছিলেন মহামতি আলেকজান্ডারের শিক্ষক। যাই হোক, পুরুকে তাঁর সামনে আনা হলে, আলেকজান্ডার পোরাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে কীভাবে তিনি তার সাথে আচরণ করতে চান।

পুরু পরাজিত হলেও সগর্বে উত্তর দিয়েছিলেন, একজন রাজা আরেকজন রাজার সঙ্গে যে সৌজন্যতা এবং মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করে, তিনি আলেকজান্ডারের কাছ থেকে সেইরকম আচরণ প্রত্যাশা করেন। আলেকজান্ডার প্রতিপক্ষের এই জবাবে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলেন, আর তাঁর সেই মুগ্ধতার মাত্রা এতটাই ছিল যে তিনি পুরুকে কেবল তাঁর নিজের রাজ্যই ফিরিয়ে দেননি, বরং বায়াস অবধি দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ভূমির অধিকারও দান করেছিলেন পুরুকে। পুরু খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ থেকে ৩১৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে মারা গিয়েছিলেন।

এই গল্প আমরা কম-বেশী সবাই শুনেছি। পুরুর বীরত্ব এবং আলেকজান্ডারের সৌজন্যে মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু এই ঘটনার মধ্যেও যে একটা ফাঁকফোঁকর রয়ে গেছে, সেটা ঠিকঠাক ধরতে পারিনি। প্রথম কথা হল, এই ঘটনা যে আদৌ ঘটেছিল কিনা, সেটা কে লিখে গেছে? খুব সম্ভবত গ্রীকরাই লিখে গেছে। তারা কি পুরুকে মহিমান্বিত করার জন্যে এই ঘটনা লিখে রেখেছে? নিশ্চয়ই নয়; আমি নিশ্চিত, পুরুর এই উত্তর উপস্থিত আলেকজান্ডারের সহযোগীদের মধ্যে তীব্র হাসির উদ্রেক করেছিল। যে সময়ে এই ঘটনা ঘটেছিল, তখন তো আর 'জেনেভা কনভেনশিন' নামের কোনো কূটনৈতিক প্রবিধি প্রচলিত ছিল না! আলেকজান্ডার নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ছিলেন, আর ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই পুরু তার রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন।

কিন্তু এই ঘটনার সবচাইতে বড় ফোঁকড়টির কথা এখনো বলা হয়নি। ধরে নিলাম, এই ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। পুরুকে সত্যিই গ্রেফতার করে আলেকজান্ডারের সামনে ধরে আনা হয়েছিল, এবং তাদের মধ্যে উল্লেখিত কথাবার্তাগুলো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যেহেতু পুরুকে তার রাজ্য আবারো ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল, সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে তাদের মধ্যে আরও কথাবার্তা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, পুরু এবং আলেকজান্ডার কোন ভাষাতে কথা বলছিলেন? আলেকজান্ডার প্রাচীন গ্ৰীক ভাষায় কথা বলতেন। অন্যদিকে, পুরু সংস্কৃত অথবা অন্য কোনো প্রাকৃত ভাষায় কথা বলতেন। আলেকজান্ডার সংস্কৃত জানতেন না, পুরু গ্ৰীক জানতেন না। তাহলে?

তাহলে কি সেখানে একজন দোভাষী উপস্থিত ছিলেন, যিনি দুটো ভাষায় জানতেন? যদি তাই হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে তৎকালীন ভারতবর্ষের সঙ্গে অন্য সভ্যতাসমূহের একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল; নইলে একাধিক ভাষায় পারদর্শী অনুবাদকদের প্রয়োজন হত না।


গল্পের ফাঁকফোঁকর -
Guitar K Kanungo
Dec. 14, 2024 | গল্প | views:534 | likes:6 | share: 2 | comments:0
ঈশপের একটি বিখ্যাত গল্প আছে —বাঘ এবং রাখাল বালকের গল্প। রাখাল বালক মাঝেমধ্যে মিথ্যে করে বাঘ এসেছে বলে চিৎকার করত, আর গ্রামবাসীরা লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসত। কিন্তু যখন তারা দেখত কোনো বাঘ নেই, তখন বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেত। একদিন সত্যিই বাঘ এলো, কিন্তু এবার আর গ্রামবাসীরা তার চিৎকারে সাড়া দিল না। তাদের ধারণা ছিল, এটি আগের মতোই মিথ্যে। ফলে, বাঘ বিনা প্রতিরোধে রাখাল বালক এবং তার গরুগুলিকে মেরে ফেলে চলে গেল।
গল্পটি শিক্ষণীয় হলেও, এতে একটি ফাঁক রয়েছে। বাঘের উপস্থিতি কি সম্পূর্ণ নিঃশব্দে হয়? ঈশপের সেই বাঘটি কি একবারও গর্জন করেনি? যদি গর্জন করে থাকে, তবে গ্রামবাসীরা তা শুনল না কেন, অথচ রাখাল বালকের চিৎকার তারা শুনতে পেয়েছিল? নাকি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এগিয়ে আসেনি, কারণ তারা চাইছিল রাখাল বালককে তার মিথ্যাচারের জন্য শাস্তি দিতে?
এবার অন্য একটি গল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক—হনুমানের। রামায়ণের অন্যতম প্রধান চরিত্র হনুমানকে আমরা সারা ভারতবর্ষে শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হতে দেখি। লক্ষণের জীবন বাঁচানোর জন্য বিশল্যকরণী নিয়ে আসতে হনুমান গন্ধমাদন পর্বতে যান। কিন্তু ঔষধি খুঁজে না পেয়ে, পুরো পর্বতটি তুলে নিয়ে আসেন।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, হনুমান শক্তির পরিচয় দিলেও বুদ্ধির পরিচয় দেননি। তার মতে, ঔষধিটি খুঁজে না পেয়ে গোটা পর্বত তুলে আনা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হনুমান কি সত্যিই নির্বোধ ছিলেন?
রাবণের মতো বিদ্বান এবং শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে দূত হিসাবে হনুমানকে পাঠানো হয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন সর্বশাস্ত্রবিদ। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ এবং বেদজ্ঞ হনুমান ব্রাহ্মণ বংশজাত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। যদি তা সত্যি হয়, তবে তাকে আর একজন 'আদিবাসী' বা 'দলিত' বলা চলে না। তাহলে হনুমান কে ছিলেন? একজন বোকা নাকি জ্ঞানী? আদিবাসী নাকি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ?
একইভাবে প্রশ্ন তোলা যায়—হনুমান বেদজ্ঞ হলেন কেন, যেমনটি বাল্মীকি বলছেন? নিষাদপুত্র একলব্যের একটি লক্ষ্য ছিল—তিনি শ্রেষ্ঠতম তীরন্দাজ হতে চেয়েছিলেন। নিষাদ জনগোষ্ঠী পেশাগতভাবে শিকারী ছিল, আর একজন নিষাদ হিসাবে একলব্য নিজের দক্ষতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই উচ্চাভিলাষ ছিল সহজাত।
কিন্তু হনুমান বেদজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য? তিনি তো এমনিতেই অত্যন্ত শক্তিমান ছিলেন। এই একটি গুণই তাঁকে অন্যদের তুলনায় বিশিষ্ট এবং অপরিহার্য করে তুলেছিল। তাঁর তো রাজর্ষি জনকের রাজসভায় শাস্ত্র নিয়ে বিতর্ক করতে যাবার কথা ছিল না। তাহলে কেন হনুমানের বেদজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন হল ?
এক্ষেত্রে কি বাল্মীকি হনুমানের মধ্যে আধুনিক কালের একজন 'সুপারম্যান'কে দেখতে চেয়েছিলেন? হনুমান কি তাহলে এমন একজন মহানায়ক যাঁর অপরিমেয় শক্তি আছে, কিন্তু নিজস্ব কোনো উচ্চাভিলাষ নেই? এমন একজন যার কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই, কেবল অসহায় এবং পীড়িতদের সাহায্যে তিনি এগিয়ে আসেন, এবং আশা করেন যে যাঁদের তিনি সাহায্য করেছেন, তাঁরাও অন্য অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসবে?

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930