এবার যীশুর পুনরুত্থানের আলোচনায় ফেরা যাক। ক্রুশবিদ্ধ করার আগে এবং ক্রুশবিদ্ধ থাকা অবস্থায় যে শারীরিক নির্যাতন যীশু সহ্য করেছেন, তাতে তিনি যে মৃত্যবরণ করেছেন, এই ব্যাপারটা নিশ্চিত—বিজ্ঞানসম্মতভাবেই নিশ্চিত। সেক্ষেত্রে তাঁকে জীবিত দাফন করা হয়েছে, এমন ভাবার কোন সুযোগ নেই। যদি জীবিত দাফন করা না হয়ে থাকে, তাহলে মৃত্যুর তিন দিন পরে তাঁর আবার কবর থেকে বেরিয়ে আসারও কোন সুযোগ নেই। মৃত্যুর মোটামুটি দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে মানব শরীরে রিগর মর্টিস শুরু হয়ে যায়। মৃত্যুর বায়াত্তর ঘণ্টা পরে, তাঁর সুস্থ শরীরে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। এখানে আরো একটা মনে রাখা দরকার, যারা বলছেন পুনরুত্থানের পর তাঁরা যীশুকে দেখেছেন, এদের কেউই নিরপেক্ষ সাক্ষী নন। এদের সবাই যীশুর শিষ্য এবং অনুরাগী। যীশুকে একজন মেসাইয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটা উদগ্র ইচ্ছা এদের মধ্যে থাকতেই পারে।
ইসলাম ধর্মের প্রচারক মুহাম্মদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার একটির কথা আগেই বলা হয়েছে। একটা ঘোড়া সদৃশ প্রাণীর পিঠে চড়ে অন্তরীক্ষে ভ্রমণ করে আসার গল্প কল্পবিজ্ঞানকেও হার মানায়। এই ঘটনার একটাই যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হতে পারে, আর সেটা হল, তিনি গোটা ব্যাপারটা স্বপ্নে দেখেছেন। সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। মুহাম্মদের ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বলা হয়েছে, যেটাকে অনায়াসে অলৌকিক বলা চলে। বলা হয়, জিব্রাইল ফেরেশতা এসে মুহাম্মদের বুক চিরে বুকের ভেতর থেকে কিছু কালো জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনেন। তারপর মুহাম্মদের হৃৎপিন্ডটাকে বুক থেকে বের করে এনে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে, সেটাকে আবার যথাস্থানে বসিয়ে দেন। মুসলমানদের কাছে এই ঘটনা সাক-আল সদর নামে পরিচিত। এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছে মুহাম্মদেরই কিছু সমবয়সী খেলার সাথী। মুহাম্মদের বয়স তখন চার বছর, এবং তাঁর খেলার সাথীদের বয়সও এর কাছাকাছি ছিল।
এই ঘটনার বর্ণনা শুনে সবার আগে যে প্রশ্নটা মনে উদিত হয়, সেটা হল, চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ কতটা গ্রহণযোগ্য। তারা নিশ্চয়ই, যদি এই ঘটনা ঘটে থাকে, গোটা ঘটনাকে দূর থেকে দেখেছে। তাহলে তারা কিভাবে বুঝতে পারল যে, যিনি এই কাজটি করছেন, তিনি জিব্রাইল? এদের কেউ কি জিব্রাইলকে আগে দেখেছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারা কিভাবে বুঝল, মুহাম্মদের বুক চিরে যে বস্তুটা বের করে আনা হয়েছে, সেটা হৃৎপিন্ড নাকি কলিজা? মরুভূমিতে বেড়ে ওঠা কিছু বাচ্চা, যাদের মানব শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে কোন ধারণা থাকার কথা নয়, তারা গড়গড় করে বলে যাচ্ছে জমাট বাঁধা রক্ত বের করে আনা হয়েছে, হৃৎপিন্ড পরিশোধন করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এটাও বলছে, সেই হৃৎপিন্ড আবার জমজমের পানি দিয়ে ক্লিন করা হচ্ছে। এইসব শিশুরা কিভাবে বুঝল, ওটা জমজমের পানিই ছিল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নয়? জিব্রাইল কি তাহলে ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন? পুরো ঘটনাটির বর্ণনা আধুনিক সময়ের ওপেন হার্ট সার্জারির কথাই মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু খোল আকাশের নিচে কোন রকম 'অ্যানেস্থেশিয়া' ব্যবহার না করে এরকম ভাবে ওপেন হার্ট সার্জারি করা কি যায়? বিশেষত যখন ড. দেবী শেঠীর মত হার্ট সার্জন যেখানে তখনো জন্মাননি। গোটা ব্যাপারটাই হাস্যকর রকমের কষ্টকল্পিত।
শুরুতেই বলেছিলাম, এরকম বুজরুকি সব ধর্মেই আছে। হিন্দু ধর্ম তার ব্যতিক্রম নয়, হতেও পারে না। নাদিয়ার মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের মহাপ্রয়াণের কথাই ধরা যাক। বৈষ্ণবরা তো বটেই, বৈষ্ণব নন এমন অনেকে হিন্দুও একথা বিশ্বাস করেন যে, মহাপ্রভু পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। অলৌকিকতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা। কোন জীবিত মানুষের পক্ষে একটি মাটির কিংবা পাথরের তৈরি বিগ্রহ মূর্তির সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মহাপ্রভু ভগবান বিষ্ণুর অবতার লীলা সম্পন্ন করে তিনি আবার জগন্নাথের মধ্যেই আবারো বিলীন হয়ে গেছেন, অনুসারী ভক্তদের কাছে মহাত্ব্যপূর্ণ করে তোলার জন্যেই যে ব্যাপারটাকে এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সেইজন্যেই, অনেকেই যেমন কোন রকমের যুক্তির ধার ধারে না গিয়ে গোটা ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করেছে, তেমনি যুক্তিবাদী মানুষরা যুক্তিহীন এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যানও করেছে। শেষোক্ত মানুষেরা মনে করে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে আসলে খুন করে তাঁর মৃতদেহ এই মন্দিরের জগন্নাথ বিগ্রহের পেছনে (অথবা অন্য কোথাও) লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এই সমস্ত অলৌকিক ঘটনাকে সাড়ম্বরে তুলে ধরার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মনে ঈশ্বর বা কোনো উচ্চতর শক্তির প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাশীল করে তোলা। অলৌকিক ঘটনা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এমন কিছু দেখানোর চেষ্টা করে যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ফলে, যারা ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কে এক ধরনের রহস্যময় ধারণার জন্ম হয়। ঈশ্বরের মহিমা, ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন সেই উচ্চতর শক্তির কাছে প্রণত হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যে ব্যাপারটাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা চলে না, সেই ব্যাপারটাকে অযৌক্তিক জেনেও বিশ্বাস করতে বলা, যে নৈতিকতা বিরোধী, সেকথাটা অনেক সময় যারা এইভাবে বিশ্বাস করতে বলেন, তাদের মনে থাকেনা। অভিজ্ঞতা এবং প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই যুক্তিযুক্ত, সেটাই সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত—এমনকি ঈশ্বর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও। ঈশ্বর যদি আমার আনুগত্য চান, তাহলে তিনি যে আছেন সেটা প্রমাণ করার দায়ভারটা একান্তই ঈশ্বরের। অযৌক্তিক অলৌকিকতা বুজরুকিরই নামান্তর।